এই উদ্দাম জনতার কাছ থেকে দূরে থাকতে পেরে যার-পর-নাই আনন্দিত আমি। জানি, আমার মনিব, ইনটেফের লোকেরা এসে গোশতের সেরা অংশটুকু এবং হাড় মজ্জা নিয়ে যাবে প্রাসাদের রসুইখানায়; আমার পছন্দের মতো করে বিশেষভাবে রান্না করা হবে খাবার। রাজ-উজিরের প্রাসাদে আমার অবস্থান বেশ উঁচুতে, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে আমার মালিকের একান্ত ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর চেয়েও; যদিও সে মুক্ত মানুষ, আমার মতো দাস নয়। কেউ এ বিষয়ে খোলাখুলিভাবে বলে না, তথাপি আমার বিশেষ অবস্থান নিয়ে কারও রা করার সুযোগটি নেই।
প্রাসাদের লোকেরা চলে এসেছে; স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে ওদের কাজ দেখতে লাগলাম আমি। আমার মনিব, প্রশাসক এবং মিশরের উচ্চ সাম্রাজ্যের রাজ-উজিরের অংশ দাবি করতে এসেছে তারা। অতি অনুশীলনে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে হাতের লাঠি দিয়ে সামনে দাঁড়ানো উন্মুক্ত পশ্চাৎদেশে আঘাত করে পথ করে নেয় ওরা, চিৎকার করে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রয়াস পায়।
নিহত জন্তুর দাঁত উজিরের সম্পত্তি। সতর্কতার সাথে তার প্রত্যেকটি সংগ্রহ করে তাঁর প্রতিনিধিরা। জলপ্রপাতের ওপারে, সেই কুশ দেশ হতে আসা হাতির দাঁতের চেয়ে কোনো অংশে কম মূল্যবান নয় সেগুলো। মন্দিরের হায়ারোগ্লিফিক্সের কথা অনুযায়ী আজ থেকে এক হাজার বছর পূর্বে শেষবারের মতো হাতি শিকার করা হয়েছিলো আমাদের এই মিশরে, চতুর্থ বংশ পরম্পরার ফারাওয়ের শাসনামলে। স্বাভাবিকভাবেই, শিকারের সেরা অংশ থেকে প্রাপ্ত পুরস্কারের অধিকাংশ হাপির মন্দিরের পুরোহিতদের তুষ্টিতে ব্যয় করবেন আমার মালিক, পবিত্র এই প্রাণীর রাখাল তো তারাই। অবশ্য উপঢৌকনের পরিমাণ নিয়ে চিন্তার অবকাশ আছে; প্রাসাদের হিসাবরক্ষক হিসেবে আমি জানি, সিংহভাগ সম্পদ কোথায় যায়। আমার মালিক, ইনটেফ অযাচিত উদারতায় বিশ্বাসী নন; তা এমনকি কোনো দেবীর প্রতিও নয়।
আর জলহস্তির চামড়াগুলো সেনাবাহিনীর অধিকারে যাবে, গার্ড বাহিনীর সৈন্যদের ঢালে ব্যবহৃত হবে সেগুলো। প্রায় বেদুইনের তাঁবুর সমান এক-একটি চামড়াকাটা তদারকি করছে সেনাবাহিনীর কসাই।
ভোজন শেষে তীরে পড়ে থাকা অবশিষ্ট মাংস আঁচার করে, নয়তো রোদে শুকিয়ে নেওয়া হবে। সেনাবাহিনীর সদস্য, আইনের লোকজন, মন্দির আর রাজ্যের কর্মীদের ভোজনে ব্যবহৃত হবে সেটা। তবে, আদপে এর বেশ কিছু অংশ বিচ্ছিন্নভাবে বিক্রি হবে, স্বাভাবিকভাবেই রাজ-উজির, আমার মালিক ইনটেফের কোষাগারে যাবে সেই অর্থ। আগেই বলেছি, স্বয়ং ফারাওয়ের পরে আমার মালিক ইনটেফ হলেন উচ্চ মিশরের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। প্রতিদিন আরো বাড়ছে তার সম্পদের পরিমাণ।
একটা শোরগোল শুনছি পেছন থেকে, দ্রুত ফিরে তাকালাম। এখনও কাজে মত্ত ট্যানাসের বাহিনী। যুদ্ধের মতো করে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে প্রতিটি গ্যালি; তীরের সাথে সমান্তরালে পঞ্চাশ গজ দূরে গভীর পানিতে রয়েছে সবকয়টা। রেইলে দাঁড়িয়ে হারপুন হাতে ল্যাগুনের জলে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে যোদ্ধারা।
রক্ত আর তাজা মাংসের গন্ধ আকৃষ্ট করেছে কুমীরের দলকে। শুধু ল্যাগুনের পানিতে নয়, সেই নীল নদের প্রধান শাখা থেকে এসে ভোজে জড়ো হয়েছে জানোয়ারগুলো। হারপুন শিকারীরা তৈরি। প্রতিটি হারপুনের ডগায় কাঁটাওয়ালা ব্রোঞ্জের মাথা রয়েছে।
হারপুন শিকারীদের দক্ষতা সত্যিই অপূর্ব। লম্বা, অশুভ ছায়ার মতো পানির তলা থেকে ভেসে উঠে একটা সরীসৃপ; কাঁটাওয়ালা ভীষণ লেজটা মসৃণভাবে নেড়ে ঘাপটি মেরে থাকে। হারপুন শিকারীরাও এ সুযোগের অপেক্ষাই থাকে। গ্যালির নিচ দিয়ে ওটাকে যেতে দেবে তারা, তারপর যখন ওপাশে চলে যাবে; হালের আড়াল থেকে ছুঁড়বে প্রাণঘাতি বর্শা।
চরম আঘাত ঠিক নয়, বরং সুতীক্ষ একটা খোঁচা বলা যায়। শল্যবিদের সুঁইয়ের মতোই ধারালো হয় হারপুনের তামার তৈরি ডগা; সরীসৃপের শক্ত আঁইশঅলা দেহের গভীরে পুরোটা গেঁথে যায় ওটা। ঘাড়ের পেছনের জায়গাটা টার্গেট করে হারপুন শিকারীরা, এক পলকে ছিন্ন করে ফেলে স্পাইনাল কর্ড।
তবে, একটি-দুটি আঘাত ব্যর্থ হতে উদ্দাম আস্ফালনে জল তোলপাড় করে শয়তান জন্তগুলো। ডগার ব্রোঞ্জের মাথাটা সরীসৃপের দেহে অদৃশ্য হতে তার সাথে সংযুক্ত দড়ি ধরে টেনে চলে যোদ্ধার দল, নিয়ন্ত্রণ করে প্রাণীটির প্রতিটি নড়াচড়া। বড় কুমীর হলে অনেক সময় চারজন মানুষের সমান হয় একেকটা গ্যালির গানওয়েলের সঙ্গে জড়িয়ে বেঁধে রাখা হয় দড়ির প্রান্ত।
সেরকম দ্বন্দ্ব-যুদ্ধে তীরে দাঁড়ানো মানুষজন চেঁচিয়ে উৎসাহ যুগিয়ে চলে যোদ্ধাদের; একবার কোনমতে কুমীরের মুখটা নিজেদের দিকে যদি করা যায়, গভীর পানিতে সাঁতরে ফিরে যেতে পারে না ওটা। জাহাজের পাশের পানিতে ফেনা আর সাদা পানির আলোড়ন তোলাই সার হয় ওগুলোর; রেইলে দাঁড়ানো যোদ্ধারা খুঁচিয়ে ভেঙে ফেলে খুলির শক্ত হাড়।
কুমীরের শবদেহ যখন নদী তীরে টেনে নিয়ে যাওয়া হলো, ওগুলোকে পরীক্ষা করতে চললাম আমি। ট্যানাস বাহিনীর কসাইরা ততক্ষণে চামড়া সংগ্রহের কাজে লেগে গেছে।
আমাদের বর্তমান রাজার পিতামহ, তার বাহিনীর নাম নীল কুমীর রক্ষীবাহিনী বলে অনুমোদন করেছিলেন; নীল কুমীর হলো তাদের পদমর্যাদা। ওদের যুদ্ধ-ঢাল নির্মিত হয় এই ভীষণ সরীসৃপের শক্ত চামড়া থেকে। সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা হলে এমনকি শত্রুর ছোঁড়া তীর বা বর্শার আঘাত দিব্যি ঠেকিয়ে দেয় ওগুলো। ধাতবের চেয়ে অনেক হালকা, মরুভূমির গরমে পরিধানের পক্ষেও ঠাণ্ডা। কুমীরের চামড়ায় তৈরি ট্যানাসের হেলমেট অসট্রিচের পালকে সজ্জিত; বুকের আচ্ছাদনও কুমীরের চামড়ার, চকচকে পালিশ করা–তামার ফুলের কারুকার্য খচিত। শত্রুর চোখে আতঙ্ক জাগানোর জন্যেই এই প্রস্তুতি। কিংবা কুমারী হৃদয়ে কাপন তোলার জন্যে।