গলুইয়ের সামনে ভেসে ওঠা একটা শবদেহ আমাদের মনোযোগ কেড়ে নেয়। প্রথম মৃত-জলহস্তির দেহ ভেসে উঠেছে ল্যাগুনের জলে। পেট উপরে দিয়ে ভাসছে ওটা, নাড়ি-ভুঁড়ির ভেতরের গ্যাসের কারণে অমনটা ঘটেছে। চার পা শক্তভাবে ছড়িয়ে ভাসছে এখন। একটা গ্যালি এগিয়ে গিয়ে দায়িত্ব নেয় দেহটার। বিশাল দেহের উপরে লাফিয়ে নেমে দড়ি বেঁধে গ্যালির সাথে সংযোগ করলো একজন যোদ্ধা। কাজ শেষ হতেই, ভাসমান দেহটা টেনে নিয়ে তীরের দিকে চললো ওটা।
এতক্ষণে আমাদের চারপাশের পানিতে ভেসে উঠতে শুরু করেছে জলহস্তির প্রাণহীন দেহ। গ্যালিগুলো ওগুলোকে বেঁধে টেনে নিয়ে চললো । আমাদের জাহাজের সাথে দুটো জানোয়ারের দেহ আঁটকে নিলো ট্যানাস; দাঁড়ীরা প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় বেয়ে চললো হোরাসের প্রশ্বাস।
তীরের কাছাকাছি এসে পড়তে হাত উঁচিয়ে রৌদ্র আড়াল করে সামনে তাকালাম। মনে হলো যেনো উচ্চ-মিশরের সকল নারী, পুরুষ আর শিশু জড়ো হয়েছে নদীর পারে। বহু লোক; নাচছে, গাইছে স্তুতি করে চলেছে শিকারী যোদ্ধাদের। তাদের পরিহিত সাদা আলখাল্লা পতপত করে উড়ছে বাতাসে, যেনো কোনো ঝড়ের প্রস্তুতি।
পাড়ের কাছাকাছি চলে আসতে, কেবল কোমরে এক টুকরো কাপড় পরা মানুষজন কাধ-সমান পানিতে নেমে এসে ভাসমান প্রাণীগুলোর শবদেহে দড়ি বেঁধে দিতে থাকে। উত্তেজনার প্রাবল্যে মনেই নেই, হ্রদের সবুজ জলের তলায় ঘাপটি মেরে আছে হিংস্র কুমীরের দল। প্রতি বছর আমাদের বহু লোক প্রাণ হারায় এই ভয়ঙ্কর জম্ভর হাতে। কোনো কোন সময় এতটাই সাহসী হয়ে উঠে, নদী পাড়ে খেলতে থাকা শিশু কিংবা কাপড় ধুতে থাকা মেয়েলোক বা পানি নিতে আসা মহিলাদের পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায় কুমীর।
এখন, মাংস-ক্ষুধায় কাতর লোকগুলোর মনে নেই অন্য কিছুর কথা। দড়ি ধরে টেনে পারের দিকে নিয়ে চলে তারা নিহত জানোয়ারগুলোকে। পাড়ের কাঁদাটে মাটিতে ঝড়ে পড়ে নিহত জলহস্তির দগদগে ঘায়ে মুখ বসানো ছোটো ছোটো মাছের দল। চকচকে রুপোর মতো দেখায় ওগুলোকে, মাটির উপর তড়পাচ্ছে যেনো আকাশের খসে পড়া তারা।
পুরুষ বা নারী প্রত্যেকে ছুরি বা কুঠার বহন করছে; পিলপিলে পিঁপড়ের মতোই শবদেহগুলো ঘিরে আসে তারা। লোভের আতিশায্যে উন্মত্ত হায়েনা বা শকুনের মতোই পরস্পরের উদ্দেশ্যে বকে চলে, একের পর এক আঘাত করতে থাকে জলহস্তির বিশাল নিথর দেহে। ছুরি বা কুঠারের কোপে বাতাসে ছিটকে আসে রক্ত আর হাড়ের কণা। সেই সন্ধায় আহত লোকের কোনো অভাব হবে না মন্দিরে; কাটা আঙুল বা অসাবধান কোপের চিকিৎসা দরকার হবে এদের।
আমি নিজেও সম্ভবত অর্ধেক রাত জেগেই কাটাতে বাধ্য হবো। চিকিৎসক হিসেবে কোনো কোন মহলে বিশেষ নাম আছে আমার, ক্ষেত্রবিশেষে ওসিরিসের মন্দিরের পুরোহিতদের চেয়ে বেশি। বিনয়ের সাথেই বলছি, এই যশ অযাচিত নয়; আর হোরাস জানেন, পুরোহিতদের তুলনায় আমার অর্থ-দাবি অযৌক্তিক নয় মোটেও। আমার মালিক, প্রভু ইনটে, চিকিৎসাকর্ম থেকে প্রাপ্ত আয়ের তিন ভাগের এক ভাগ আমাকে দিয়ে থাকেন। দাস হতে পারি, তবে কিছুটা হলেও সম্মান আমার আছে বৈকি।
হোরাসের প্রশ্বাসের স্টার্ন টাওয়ারে দাঁড়িয়ে মানব-চরিত্রের উন্নাসিকতা অবলোকন করতে লাগলাম আমি। ঐতিহ্যগতভাবে, তীরে থাকা অবস্থায় নিজের ভাগের মাংস খেতে পারে জনতা। আমাদের এই নদী-বিধৌত, উর্বর জনপদে মানুষজন ভুখা থাকে না। তবে আমাদের প্রধান খাদ্যশস্য; মাসের পর মাসে কেটে যায়, মাংসের স্বাদ আমাদের লোকজন পায় না। আর তাছাড়া, উৎসবের সময় সব বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়; দেহজ ভোগ-বিলাস, খাদ্য, পানীয়-সবক্ষেত্রেই চলে অতি-উপভোগের অনুশীলন। বিষাক্ত পেট, মাথাব্যথায় কাতর লোকের দল আজ আসতেই থাকবে মন্দিরে; উৎসবের প্রথম দিনে ক্ষুধা মেটে না এদের।
পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্ত আর চর্বিতে মাখামাখি এক মেয়ে, বুক পর্যন্ত নগ্ন; বেরিয়ে আসে জলহস্তির পেটগহ্বর থেকে, হাতে ঝুলছে কলিজার একটা বড় টুকরো, নিজের সন্তানের হাতে দৌড়ানোর উপরই ওটা ছুঁড়ে দেয় সে। শবদেহ ঘিরে আস্ফালনে রত তার অন্যান্য বংশধরেরা। আবারো নিহত প্রাণীটার শরীরের অভ্যন্তরে হারিয়ে যায় সে; ওদিকে তীর ঘেঁষে তৈরি করা শতাধিক আগুনের কুণ্ডলির উদ্দেশ্যে হাতের মাংসপিণ্ড নিয়ে ছুটে যায় শিশুটা। ওর হাত থেকে কলিজার বড় অংশ ছিনিয়ে নিয়ে জ্বলন্ত কয়লায় ছুঁড়ে ফেলে তার বড় ভাই; বাকিরা আগ্রহের আতিশায্যে ঘিরে আসে তাকে ঠিক যেনো একপাল কুকুরছানা।
একটা কাঠি দিয়ে আধা-সেদ্ধ কলিজার কিছু অংশ খুবলে নেয় বয়োজৌষ্ঠ ছেলেটা, তার ভাইবোনেরা মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাবড়ে দেয় ওটা। শেষ হতে না হতেই, আরো পাওয়ার দাবিতে শোরগোল তোলে ওরা; রস আর তরল চর্বি গড়িয়ে পড়ছে চিবুক বেয়ে। এদের মধ্যে অনেকেই জীবনে কখনও জলহস্তির মাংসের স্বাদ পায়নি। বেশ সুস্বাদু, নরম–তবে বেশিরভাগ অংশই চর্বি গরু বা বুনো গাধার গোশের চেয়ে পরিমাণে অনেক বেশি। হাড়ের মজ্জা অবশ্য এমনকি দেবতা ওসিরিসের প্রিয় খাদ্য। আমাদের লোকেরা পশুর চর্বি কালেভদ্রে খেতে পায়, ওটার স্বাদ তাদের পাগল করে ফেলে। প্রাণভরে খাবে ওরা আজ, এটা তাদের অধিকার আজকের দিনে।