হ্যাঁ, হরিণই বটে। বড় শিং-নাকি বড় খুর ছিল? আপনাকে এখন যেমন পরিষ্কার দেখছি, তেমনি পরিষ্কার দেখেছি। তবে পায়ের দিকে খেয়াল করিনি, তাই খুরগুলো বড় ছিল কি না বলতে পারছি না। তবে ওটার দৌড়তে যে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না এটুকু বলতে পারি।
অন্য সময় হলে বোকার মতো কথা শুনে হয়তো হেসে ফেলত ব্যারন। কিন্তু এতক্ষণে হরিণটার কাছে বার বার নাকানি-চুবানি খেয়ে ধৈর্য্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে সে।
যথেষ্ট হয়েছে। আমি মজা করার মানসিকতায় নেই।
মাই লর্ড আমাকে যে মানসিকতায় চাইবেন, আমি তাতেই থাকব।
তাহলে প্রশ্নের জবাব দে।
কিছু তো জিজ্ঞেসই করেননি।
হরিণটাকে কি ক্লান্ত মনে হয়েছে?
খুব একটা না।
কোন্ পথে এসেছিল?
আসেনি তো, দাঁড়িয়ে ছিল।
কোন না কোন পথে তো নিশ্চয়ই এসেছিল।
তা তো বটেই, তবে আমি দেখিনি।
কোন্ পথে গেছে?
মাই লর্ড, আপনাকে অবশ্যই বলতাম, কিন্তু ওকে যেতেও দেখিনি।
লর্ড ভে থিবল্টের দিকে রাগী চোখে তাকালেন।
তো জনাব গোবেচারা, হরিণটা কি অনেকক্ষণ হলো এদিক দিয়ে গেছে?
খুব বেশিক্ষণ নয়।
কতক্ষণ?
থিবল্ট মনে করার ভান করল, বোধহয় পরশুদিন, বলার সময় মুখের হাসিটা লুকাতে পারল না ও। ব্যারনও হাসিটা দেখে চাবুক উঁচিয়ে থিবল্টের দিকে এগিয়ে গেল।
একছুটে গিয়ে ঘরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল থিবল্ট।
তুই প্রলাপ বকছিস মিথ্যেবাদী! বিশ গজও হবে না, মাক্যাসিনো, মানে আমার সেরা হাউন্ডটা ডাকাডাকি করছে। ওদিকে যদি গিয়ে থাকে, তাহলে হরিণটা এদিক দিয়েই গেছে। আর এদিক দিয়ে গেলে তুই দেখিসনি এটা হতেই পারে না।
ক্ষমা করবেন মাই লর্ড। আমাদের ভালমানুষ পাদ্রীর কথা অনুযায়ী পোপ ছাড়া আর সবারই ভুল হতে পারে। মঁসিয়ে মাক্যাসিনোও সম্ভবত ভুল করেছেন।
কান খুলে শুনে রাখ বদমাশ, মাক্যাসিনো কখনও ভুল করে না। আর প্রমাণ হিসেবে মাটির ওপর আমি হরিণটার পায়ের চিহ্ন দেখতে পাচ্ছি।
ব্যারনকে ভুরু কোঁচকাতে দেখে অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করল থিবল্ট, যা-ই হোক, মাই লর্ড আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলছি…
চুপ, এদিকে আয় বদমাশ।
ব্যারনকে আর রাগানোটা ঠিক হবে না, হয়তো আবার কিছু জিজ্ঞেস করবে ভেবে একটু ইতস্তত করে হলেও বেরিয়ে এল বিবল্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্য থিবল্টের, যতটুকু রাগার এরইমধ্যে রেগে গেছে লর্ড ভেয। আড়াল ছেড়ে বেরোনো মাত্র
ওর দিকে তেড়ে গেল সে। চাবুকের বাট দিয়ে বাড়ি মারল ওর মাথায়!
আঘাতের আকস্মিকতায় সামনের দিকে ঝুঁকে গেল থিবল্ট। ঠিক তখনই ব্যারন ওর বুকে গায়ের জোরে একটা লাথি কষাল। লাথির ধাক্কায় থিবল্ট পেছন দিকে উড়ে গিয়ে কুঁড়ের দরজার উপর আছড়ে পড়ল।
চাবুক চালিয়ে ব্যারন বলল, নে, এটা মিথ্যে বলার জন্য! আর পা চালানোর পর বলল, আর এটা অনর্থক বাজে বকার জন্য!
পড়ে থাকা মানুষটার দিকে ফিরেও তাকাল না সে। এদিকে মাক্যাসিনোর ডাক শুনে বাকি হাউডগুলোও এসে হাজির হয়েছে। শিঙা ফুঁকে ওদের উৎসাহ দিতে দিতে ছুটে চলে গেল ব্যারন।
উঠে দাঁড়াল থিবল্ট। ভাল করে দেখে নিল কোন হাড় ভেঙেছে কি না।
নাহ, হাড়গোড় কোনটা ভাঙেনি, সব ঠিকই আছে। তো ব্যারন সাহেব, প্রিন্সের বেজন্মা মেয়েকে বিয়ে করেছ বলে মানুষের সাথে এমন ব্যবহার করছ। একটা কথা বলে রাখি, ওই হরিণ আর তোমার কপালে নেই! এই গোবেচারা, বেওকুফ, বদমাশের ভাগ্যেই হরিণটা জুটবে। এটা আমার প্রতিজ্ঞা! চিৎকার করে বলল থিবল্ট। আর প্রতিজ্ঞা করে যে রাখতে পারে না, সে তো পুরুষই নয়!
তাড়াতাড়ি শিকারের অস্ত্র নিয়ে তৈরি হলো থিবল্ট। যেদিক থেকে হাউন্ডগুলোর চিৎকার চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে, সেদিকেই ছুটল ও। একজন মানুষের পক্ষে যত জোরে ছোটা সম্ভব। হরিণ আর তার পিছু ধাওয়াকারীদের বাঁকানো পথের দিক আন্দাজ করে নিল। তারপর কোনাকুনি সেদিকে ছুটল, যাতে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছতে পারে।
দৌড়াতে দৌড়াতেই হরিণটাকে কীভাবে শিকার করবে, একমাস ধরে কীভাবে খাবে সেই পরিকল্পনা করতে লাগল থিবল্ট। ফলশ্রুতিতে ব্যারন আর তার লোকদের ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হবে। এটাই হবে লোকটার অহেতুক নিষ্ঠুরতার জবাব। ভাবতে ভাবতে আপনমনেই হেসে উঠল ও।
থিবল্টের হিসাব অনুযায়ী হরিণটা নিকটবর্তী একটা কাঠের সেতুর দিকে যাবে। তাই সেতুটার কাছেই একটা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল ও।
অল্পক্ষণ পরেই হরিণটার দেখা পাওয়া গেল। বাতাসে কান খাড়া করে শত্রুর আওয়াজ শোনার চেষ্টা করছে। উত্তেজিত হয়ে উঠল থিবল্ট। আড়াল থেকে উঠে জন্তুটাকে লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল হাতের বর্শাটা।
হরিণটা প্রথম লাফে সেতুর অর্ধেক, দ্বিতীয় লাফে বাকি সেতু আর তৃতীয় লাফে পগার পার!
এক ফুটের জন্য হরিণকে মিস করে ঘাসে নাক খুঁজল বর্শাটা। থিবল্টের জানা ছিল না এত বাজে ভাবে বর্শা ছোঁড়াও ওর পক্ষে সম্ভব। যাদের সাথে পুরো ফ্রান্স চক্কর দিয়ে এসেছে, তাদের মধ্যে ওর নিশানাই ছিল সবচাইতে নিপুণ। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ হলো থিবল্টের। বর্শাটা তুলে নিয়ে হরিণটার প্রায় সমান ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ওটার পিছু নিল আবার।
এলাকাটা হরিণটার চেয়ে কম চেনে না ও। আবারও আগেভাগে অনুমান করে পথের পাশে লুকিয়ে পড়ল। এবার প্রাণীটা অনেক কাছ দিয়ে গেল। কিন্তু বিধিবাম! বর্শা দিয়ে বাড়ি মারবে, না ওটা ছুঁড়ে-মারবে ভাবতে ভাবতে হরিণটা ওকে পার হয়ে গেল। অবশেষে ওটা যখন প্রায় বিশ কদম দূরে সরে গেছে, তখন বর্শা ছুঁড়ল থিবল্ট। কিন্তু এবারও পরিণতি আগের মতোই হলো-লক্ষ্যভেদ করতে পারল না ও।