তা কোথায় তোমার এই হরিণ? জিজ্ঞেস করল ম্যাকোট। সাবধান, অহেতুক আমাদের দৌড় করিও না।
ম্যাটাডো আর জুপিটাকে আমার সাথে দিন, তারপর দেখুন। ম্যাটাডো আর জুপিটা লর্ডের সেরা দুই শিকারি কুকুর। সত্যি সত্যিই এনগুভা ওদের নিয়ে শ খানেক গজ এগোতে না এগোতেই বিশাল একটা পুরুষ হরিণ চোখে পড়ল। ম্যাকোট শিঙায় ফুঁ দিল। যদিও কালো নেকড়েটা পেলে ভাল হত, তারপরও যা পাওয়া গেছে তাতেই সম্ভষ্ট লর্ড ভেয। শুরু হলো ধাওয়া-দুঘণ্টা ধরে অক্লান্ত ভাবে ছুটল হরিণটা।
নিচু জমিতে ছোট নদীর কাছে পৌঁছে গতি একটু কমলো ওটার। কিন্তু পানি পেরিয়ে তীরে উঠেই আবার ছুটতে লাগল। শিকারি কুকুরগুলোও নাছোড়বান্দা। ছড়িয়ে পড়ে হরিণটার গন্ধ খুঁজে বের করল ওগুলো। ব্যারন আর তার শিকারিরা সেইন্ট আঁতোয়ার পুকুরে পৌঁছল। এদিকেই বাস করে স্যাবট-কারিগর, থিবল্ট।
বয়স পঁচিশ থেকে সাতাশের মধ্যে ওর, লম্বা, সুঠামদেহী। বিষণ্ণতায় ভোগে থিবল্ট। প্রতিবেশী যারাই ওর চেয়ে ভাল আছে, তাদের প্রতি এক ধরনের ঈর্ষা নিয়ে বেঁচে আছে ও। ওই সময়ে, এখনকার মতো নিজের জন্মগত সামাজিক অবস্থান থেকে উত্তরণের উপায় ছিল না। অক্ষরজ্ঞান ছিল থিবল্টের। কিছুটা ল্যাটিন ভাষাও জানত। প্রচুর বই পড়ত ও। তবে এত পড়াশোনার পরও, ভাল মন্দের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে ওর দুর্বলতা ছিল।
বিশ বছর বয়সে জুতো-প্রস্তুতকারীর পেশা বাদ দিয়ে, অন্যকিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখত থিবল্ট। সেনাবাহিনীতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল ওর। কিন্তু পরিচিতরা সবাই পাঁচ-ছয় বছর গাধার খাটুনি খেটেও কোন পদোন্নতি পায়নি-কেউ এমনকি সামান্য কর্পোরালও হতে পারেনি।
নৌ-বাহিনীতেও একই অবস্থা। কোন জুতো-প্রস্তুতকারীর ছেলে পদোন্নতি পেয়েছে এমনটা কখনও শোনেনি ও।
নোটারি হিসেবে কলম পিষে বড় হওয়ার স্বপ্নও দেখেছিল। কিন্তু শুরু করতে যে ত্রিশ হাজার ফ্লা দরকার, সেটা আর যোগাড় করা সম্ভব হয়নি।
এর মাঝে থিবল্টের বাবা মারা গেল। তাকে কবর দেয়ার পর ওর হাতে তেমন কোন টাকা পয়সা ছিল না। বছর তিনেক ফ্রান্সের নানা অঞ্চলে ঘুরে বেড়াল ও। তখন অনেক কিছুই শিখেছে। ভালো নাচতে শিখেছে, চমঙ্কার লাঠি খেলতে শিখেছে, শিখেছে বর্শা দিয়ে শিকার করতে। আর একটা জিনিস শিখেছে-একজন ব্যবসায়ীর কথার যে দাম আছে, প্রেমাস্পদের কথার সে দাম নেই। অনেক অভিজাতের চেয়েই থিবল্ট সুদর্শন, শক্তিশালী, বুদ্ধিমান। কিন্তু তারপরও ওর সামাজিক অবস্থানের কোন উন্নতি হলো না। কেন ও গরীব ঘরে জন্মেছে, কোন অভিজাত ঘরে নয়, সে-ই আফসোস ওকে কুরে কুরে খায়।
থিবল্ট আবিষ্কার করল, এইসব নাচ, খেলাধুলায় অহেতুক পরিশ্রম ছাড়া কিছু হয় না। ওর বাবা যদি জুতো তৈরি করে জীবন ধারণ করতে পেরে থাকে, সে-ও পারবে। আর তাই অরলিয়ন্সের রাজকীয় পদমর্যাদাধারী লুই ফিলিপের স্টুয়ার্ডের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে বনে একটা কুঁড়েঘর তৈরি করে জুতো তৈরির ব্যবসা শুরু করল।
নিজের হাতেই ঘর আর আসবাবপত্র তৈরি করল থিবল্ট।
তিন বছর হয়ে গেল ও ফিরে এসে সব গুছিয়ে বসেছে। ওর ত্রুটি বলতে অন্যের প্রতি ঈর্ষাবোধটাই যা। কিন্তু তাতে করে কারো কোন ক্ষতি অন্তত হচ্ছিল না।
দ্বিতীয় অধ্যায় – সিনর জাঁ এবং স্যাবট-কারিগর
শরতের মাঝামাঝি। থিবল্ট খোলা জায়গায় কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ মুখ তুলে কয়েক পা দূরে কম্পমান পশুটাকে দেখতে পেল ও। হরিণটার ভীত চাহনির আড়ালে বুদ্ধির ছটা লক্ষ করা যায়। থিবল্ট অনেকক্ষণ ধরেই টের পাচ্ছিল যে ওটা ওর কুঁড়ের পাশ দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। শিকারিদের এড়ানোর চেষ্টায় কখনও গ্রামের দিকে যাচ্ছে আবার ফিরেও আসছে।
থিবল্টের জন্য এতে বিস্ময়ের কিছু না থাকলেও ও হাতের কাজ থামিয়ে দিল।
বাহ্! উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল ও, কী চমৎকার প্রাণীটা। মাংসের স্বাদও খুব ভাল হবে। বছর চারেক আগে ভোফিনে জুতো কারিগরদের একটা ভোজ হয়েছিল। সেখানে খেয়েছিলাম এমন হরিণের মাংস। ভাবতেই জিভে জল চলে আসছে। যারা রোজ এমন মাংস খেতে পায় তারা আসলেই ভাগ্যবান। এই লর্ডেরা প্রতি বেলায় মাংস আর ওয়াইন দিয়ে খুঁড়িভোজ করে। আর এদিকে আমি হতভাগা শুধু আলু আর পানি খেয়ে দিন কাটাচ্ছি। এমনকি রবিবারেও সবসময় ভাল এক টুকরো বেকন আর সজী জোটে না।
থিবল্ট নিজের সাথে কথা শুরু করতেই হরিণটা হাপিশ! হাতের কাজটা গুছিয়ে উঠতেই কর্কশ একটা কণ্ঠ ওকে উদ্দেশ করে হেঁকে উঠল, এই যে বেওকুফ! শোন এদিকে।
কুকুরগুলোকে অস্থির দেখে ব্যারন নিশ্চিত হতে চাইছিল ভুল দিকে যাচ্ছে না তারা।
এই গাধা! জানোয়ারটাকে দেখেছিস?
ব্যারনের কথার ধরণ আমাদের দার্শনিক জুতোর কারিগরের ঠিক পছন্দ হলো না। তাই জেনেও না জানার ভান করল ও, কোন্ জানোয়ার?
আরে মুখপোড়া! যে হরিণটা আমরা তাড়া করছি। এদিক দিয়েই তো যাওয়ার কথা ওটার। এত সুন্দর একটা হরিণ দেখতে না পাওয়ার কোন কারণ নেই। জলদি বল্ কোনদিকে গেছে, নয়তো মার খাবি।
বিড়বিড় করে থিবল্ট নিজেকে বলল, প্লেগ হোক তোর নেকড়ের বাচ্চা। তারপর মুখে গোবেচারা ভাব ফুটিয়ে জোরে বলল, ও হরিণ! হ্যাঁ দেখেছি তো।
বিশাল শিংওয়ালা একটা সুন্দর হরিণ, তাই না?