কেঁপে উঠে একজন কিপার বলল, মোকেট, তুমি নিশ্চয়ই ভাবছ না…
অবশ্যই তা ভাবছি। আজ আমরা স্যাবট-কারিগর, থিবল্টের নেকড়ের মুখোমুখি হয়েছিলাম।
সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগল। দু-তিন জন বুকে ক্রুশ আঁকল। বোঝা যাচ্ছে, সবাই থিবল্টের নেকড়ের গল্পটা জানে এবং মোকেটের সঙ্গে একমত। একা আমিই কিছু জানি না। অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম, এই স্যাবট-কারিগর থিবল্টের নেকড়ের ঘটনাটা কী?
মোকেট একটু ইতস্তত করে জবাব দিল, জেনারেল বলেছিলেন আপনার বয়স পনেরো হওয়ার আগে যেন এই গল্পটা না বলি। আপনার বয়স তো পনেরো হয়েছে, তাই না?
আমি কিছুটা গর্বের সুরেই বললাম, আমার মোলো চলছে।
তাহলে তো হয়েই গেল, মঁসিয়ে আলেক্সান্ডার। স্যাবট-কারিগর থিবল্টের নেকড়ে হচ্ছে স্বয়ং শয়তান। কাল রাতে আপনি গল্প শুনতে চেয়েছিলেন না?
হ্যাঁ।
আমার সাথে বাড়ি চলুন। আজ আপনাকে একটা গল্পের মতো গল্প বলব।
শিকারি এবং কিপারেরা মাথা নেড়ে যে যার পথ ধরল। আমিও মোকেটের সাথে ফিরে এলাম। তারপর মোকেট আমাকে যে গল্পটা বলল, সেটাই আমি এখন আপনাদের বলব। আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে কেন আজ এত বছর পর গল্পটা আমি বলছি। আসলে এই গল্পটা আমার স্মৃতির এক মণিকোঠায় লুকিয়ে ছিল। দিন তিনেক আগে আবার খুঁজে পেয়েছি। কী আমাকে গল্পটা বলতে উৎসাহিত করল তা আমি বলতে পারি, কিন্তু ভয় হচ্ছে তা আপনাদের ভাল না-ও লাগতে পারে। আর তাছাড়া বলতে সময় লাগবে। তাই অহেতুক দেরি না করে গল্পটা শুরু করছি।
আমার গল্প শুরু করি। বলা ভাল মোকেটের গল্প, আমার ভাষায়। আটত্রিশ বছর যদি একটা ডিমের ওপর বসে থাকেন, সে-ই ডিমটা আপনি পেড়েছেন না অন্য কেউ, তাতে বোধহয় খুব বেশি কিছু যায় আসে না!
০১. নেকড়েদের গ্র্যান্ড মাস্টার
প্রথম অধ্যায় – নেকড়েদের গ্র্যান্ড মাস্টার
ভেযের ব্যারন সিনর জাঁ, শিকারে অত্যুৎসাহী একজন মানুষ।
বেভাল আর লোগোর মাঝে একটা উপত্যকার অবস্থান। সেখানে একটা উঁচু টাওয়ার আছে। এককালে এটা ভেযের প্রাসাদোপম বাসস্থানের অংশ ছিল। এখন সবার জন্য উন্মুক্ত থাকলেও, যখনকার কথা বলছি, অর্থাৎ ১৭৮০ সালের দিকে তা ছিল না। দুৰ্গটা নির্মিত হয়েছিল বারো কি তেরো শতকের দিকে।
এখন পথচারীরা বা পশুপাখি ঝড় বৃষ্টির সময় অনায়াসে এখানে আশ্রয় নেয়ার কথা ভাবতে পারে। কিন্তু তখন সাধারণ মানুষ এটাকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে দেখতে পারত না। অতীতের সেই জাকজমক, পাহারা, সৈন্য-সামন্ত আর নেই। নেই বিপদের ছায়া দেখলেই ঝুল সেতু উঠিয়ে নেয়া বা পোর্টকুলিস নামিয়ে দেবার ব্যবস্থা। কিন্তু এখনও এর বিশালতা মানুষকে বিস্মিত করে।
এই দুর্গের লর্ডকে বাইরে থেকে খুব জাদরেল মনে হত। কিন্তু যারা তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনত তারা জানত-সে যত গর্জে তত বর্ষে না। তবে বনের পশুপাখির ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। সে ছিল ওদের আজন্ম শত্রু।
ভেযের লর্ড ছিল নেকড়ে শিকারিদের নেতা। এই পদমর্যাদার কারণে নেকড়ে শিকারের ভূত মাথায় চাপলে তাকে থামানো যেত না।
উপরন্তু তার স্ত্রীর ব্যাপারে রটনা ছিল যে সে নাকি প্রিন্সের মেয়ে-যদিও অবৈধ! নিজের পদমর্যাদার এবং ক্ষমতাবান শ্বশুরের বদৌলতে, কেউ তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহসও পেত না।
লর্ড প্রায় প্রতিদিনই শিকারে বেরোত লোকলস্কর নিয়ে। শিকারের সময় তার সাথে থাকত গোটা বারো ঘোড়া আর চল্লিশটা কুকুর। শিকার হিসাবে লোকটার প্রথম পছন্দ ছিল নেকড়ে, তারপর বুনো শুয়োর এবং সবশেষে হরিণ।
তবে যত ঘোড়া আর কুকুরই থাকুক না কেন, প্রতিবারই তো আর ভাল শিকার জোটে না।
এমনই একদিন, শিকারি কুকুরগুলোর প্রধান রক্ষণাবেক্ষণকারী ম্যাকোট, গম্ভীর মুখে অপেক্ষারত ব্যারনের সাথে দেখা করতে এল।
ভুরু কুঁচকে গেল ব্যারনের, কী ব্যাপার ম্যাকোট, তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে শিকারের জন্য আজকের দিনটা ঠিক সুবিধার হবে না।
মাথা নাড়ল ম্যাকোট।
খুলে বলল।
কালো নেকড়েটাকে দেখা গেছে, মাই লর্ড।
ওহ! তাই নাকি? বলার ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে, ব্যারন বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও এই পশুটার নাগাল পায়নি।
জি, ম্যাকোট বলতে লাগল। জানোয়ারটা ভীষণ চালাক, এমনভাবে দৌড়াদৌড়ি করে পায়ের ছাপ ফেলেছে, যে আমি অনুসরণ করতে করতে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, আবার সেখানেই ফিরে এসেছি।
তাহলে তুমি বলতে চাইছ, ওটাকে বাগে পাবার সম্ভাবনা নেই।
মনে হচ্ছে না।
খিস্তি করে উঠল লর্ড। মহান নমরুদের পর খিস্তি ঝাড়ায় তার সমকক্ষ আর কেউ নেই। আমার শরীরটাও বেশি ভাল লাগছে না। ওই কালো নেকড়েটার বদলে আর কী শিকার করা যেতে পারে?
নেকড়েটার পিছু নেয়ায় আর কোন পশুকে খেয়াল করতে পারিনি। লর্ড কি বেরিয়ে পড়বেন? সামনে প্রথম যেটা পাবেন, ওটাই শিকার করে নেবেন?
সম্মতি দেয়ার আগেই এনগুভাকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল।
ওই যে এনগুভা আসছে। দেখা যাক, ও কোন ভাল পরামর্শ দিতে পারে কি না।
বিনয়ের পরাকাষ্ঠা সাজল এনগুভা। আপনার মতো মহান লর্ডকে দেয়ার মতো কোন পরামর্শ আমার ঝুলিতে নেই। তবে এটা জানানো আমার দায়িত্ব যে, কাছেই একটা চমৎকার হরিণ দেখে এলাম।
চলো তোমার হরিণ দেখে আসি। ভুল খবর না হলে পুরস্কার পাবে।