সবাই যার যার অবস্থান নিয়ে নিল। আমার আর মোকেটের জায়গা পড়ল উত্তরের বনের দিকে।
এলাকাটা ঘিরে ফেলার পর কুকুরগুলোকে ছেড়ে দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল সবাই। বার দুয়েক ডেকে কুকুরগুলোও ঠাণ্ডা হয়ে গেল, এক পা-ও আর এগোয় না।
কিপার বলল, মোকেট, তোমার এই নেকড়েটা মনে হচ্ছে বিশেষ ধরনের। হোকাড়ু ও টুষে তো নড়তেই চাইছে না।
মোকেট জবাব না দিয়ে চুপ করে রইল। চায় না নেকড়েটার কাছে ওর অবস্থান ফাঁস হয়ে যাক।
কিপার গাছে বাড়ি দিতে দিতে এগোল। কুকুরগুলোও সাবধানে পেছন পেছন একপা একপা করে এগোতে লাগল। ঘেউ ঘেউ না করলেও মাঝে মাঝে মৃদু গরগর করছে।
হঠাৎ কিপারের চিৎকার শোনা গেল। আরেকটু হলেই নেকড়েটার লেজ মাড়িয়ে দিয়েছিলাম। মোকেট। খেয়াল রেখো!
তখনই নেকড়েটা লাফ দিয়ে আমাদের মাঝ দিয়ে বিদ্যুতের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল। বিশাল আকার ওটার, বয়সের কারণে সাদা হয়ে গেছে গায়ের রঙ। ঘুরেই ওটাকে লক্ষ্য করে দুটো গুলি ছুঁড়ল মোকেট। আমি দেখলাম লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গুলি দুটো বরফে নাক গুঁজেছে।
গুলি করো! গুলি করো! আমাকে তাগিদ দিল মোকেট।
তাক করে গুলি ছুঁড়লাম। নেকড়েটাকে দেখে মনে হলো কাঁধ কামড়ে ধরতে চাইছে।
লেগেছে! ছেলেটা গুলি লাগিয়েছে।
কিন্তু নেকড়েটা না থেমে মনা আর মিদে যেদিকে আছে সেদিকে ছুটে গেল।
নেকড়েটা খোলা প্রান্তরে থাকতেই ওরা প্রথম দফা গুলি ছুঁড়ল। ওটা জঙ্গলে ঢুকতে দ্বিতীয় দফা। কল্পনা করা কঠিন যে ওদের গুলি ফসকে গেছে। একটাও গুলি মিস না করে, মনাকে সতেরোটা পাখি পর পর শিকার করতে দেখেছি আমি নিজে। আর মিদেকে দেখেছি এক গাছ থেকে আরেক গাছে লাফ দিয়ে যেতে থাকা কাঠবিড়ালি পেরে ফেলতে।
জঙ্গলে নেকড়েটাকে খুঁজতে গেল কিপাররা। একটু পর ব্যর্থ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে এল।
এতক্ষণে বহুদূর চলে গেছে ওটা।
পালিয়ে গেছে। তারমানে ওদিককার গাধাগুলোও মিস করেছে।
বলে কী লাভ? তুমি নিজেও তো মিস করেছ।
কোন একটা অশুভ ব্যাপার আছে এরমধ্যে। আমার মিস না হয় হলো, তাই বলে মনাও দুবার মিস করবে, এটা তো সম্ভব না।
কিন্তু তাই ঘটেছে।
মোকেট আমাকে বলল, সে যাই হোক, আপনি কিন্তু লাগিয়েছেন।
১০
তুমি… তুমি নিশ্চিত?
আমাদের জন্য ব্যাপারটা লজ্জাজনক। তবে আমার নাম মোকেট, এটা যেমন সত্যি; আপনি গুলি লাগিয়েছেন-সেটাও তেমন সত্যি।
আমার গুলি যদি লেগে থাকে, তাহলে বরফে রক্ত থাকবে। এসো মোকেট, দেখে আসি। বলেই ছুট লাগালাম।
দাঁত কিড়মিড় করে পা দাপিয়ে মোকেট বলল, আর যা-ই করুন, দয়া করে ছুটবেন না। যতক্ষণ না পুরো ঘটনাটা পরিষ্কার হচ্ছে, আমাদের সাবধানে। চলাফেরা করা উচিত।
ঠিক আছে, চুপিচুপিই সই, তবু চলো।
মোকেট নেকড়েটার পায়ের ছাপ অনুসরণ করতে শুরু করল।
ছাপ হারানোর ভয় নেই।
সেটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
হুম। কিন্তু আমি অন্য জিনিস খুঁজছি।
কী?
দুই-এক মিনিটের মধ্যেই জানতে পারবে।
অন্য শিকারিরাও এসে আমাদের সাথে যোগ দিল। কিপার পরিস্থিতিটা তাদের ব্যাখ্যা করে বোঝাল। এদিকে আমি আর মোকেট পায়ের ছাপ পর্যবেক্ষণ করছি। বরফে গম্ভীর হয়ে বসে গেছে ছাপগুলো। অবশেষে আমরা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছলাম।
দেখেছ মোকেট, আমার গুলিটাও লাগেনি।
কীভাবে বুঝলেন?
বরফে কোন রক্তের দাগ নেই।
তাহলে বরফে আপনার গুলির চিহ্নটা খুঁজে বের করুন।
যেদিকে গুলিটা যেতে পারে সেদিকে এগোলাম। অনেকটা জায়গা জুড়ে ব্যর্থ অনুসন্ধান চালিয়ে মোকেটের কাছে ফিরে এলাম। কিপারদের এগোবার ইঙ্গিত করে ঘুরে আমাকে বলল, বুলেট?
খুঁজে পাইনি।
আমি তো তাহলে আপনার চেয়ে ভাগ্যবান। আমি খুঁজে পেয়েছি।
তুমি পেয়েছ?
আসুন আমার সাথে।
বাকি শিকারিদের সাথে আমিও মোকেটের কাছে গেলাম। মিদে আর মএনাও যোগ দিল। মোকেট ওদের দিকে তাকাল, কী খবর?
দুজনেই বলল, গুলি মিস করেছে।
প্রান্তরের গুলি মিস করতে দেখেছি। কিন্তু জঙ্গলের গুলি?
ওগুলোও লাগাতে পারেনি।
তোমরা নিশ্চিত?
দুটো গুলিই গাছের গুঁড়িতে পাওয়া গেছে।
ভেটা বলল, বিশ্বাস হতে চাইছে না।
হুম, কিন্তু একটা জিনিস দেখানোর আছে যেটা বিশ্বাস করা আরও কঠিন হবে।
দেখাও তাহলে।
ওদিকে বরফের ওপর তাকাও। কী দেখতে পাচ্ছ?
নেকড়ের পায়ের ছাপ, তো?
ডান পায়ের ছাপের দিকে খেয়াল করো, দেখতে পাচ্ছ?
একটা ছোট্ট ফুটো।
কী বুঝলে? বিস্ময়ে শিকারিরা একজন আরেকজনের দিকে তাকাল।
কী বুঝলে? আবার জিজ্ঞেস করল মোকেট।
অসম্ভব!
অসম্ভব হলেও সত্যি। আমি প্রমাণ করে দেব। বলে বরফে হাত ঢুকিয়ে দিল। একটুক্ষণ হাতড়ে একটা চ্যাপ্টা বুলেট বের করে নিয়ে এল।
এটা তো আমার গুলিটা। বললাম আমি।
চিনতে পারছেন তাহলে?
অবশ্যই, তুমিই তো চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলে।
কী চিহ্ন দিয়েছিলাম?
ক্রুশ চিহ্ন।
সবাই দেখেছেন?
হ্যাঁ। কিন্তু এর ব্যাখ্যা কী?
আর দশটা সাধারণ গুলি ফিরিয়ে দিতে নেকড়েটার কোন সমস্যা হয়নি। কিন্তু ক্রুশ চিহ্ন আঁকা গুলি সে ফেরাতে পারেনি। আমি ওটাকে দেখেছি কাঁধ কামড়ে ধরার চেষ্টা করতে।
শিকারিদের মাঝে নীরবতা নেমে এল। আমি প্রশ্ন করলাম, কিন্তু গুলিটা যদি লেগেই থাকবে, তাহলে মরল না কেন নেকড়েটা?
কারণ গুলিটা সোনা বা রূপো দিয়ে তৈরি নয়; আর ওই দুই ধাতুর তৈরি নাহলে কোন গুলির ক্ষমতা নেই শয়তানকে বা তার অনুসারীদের মারার বা তাদের চামড়া ভেদ করার।