নিজের এলাকায় ফিরে মুক্তভাবে নিঃশ্বাস নিল থিবল্ট। ও এখন দাঁড়িয়ে আছে উক নদীর ধারে। ওপার থেকে নদীর ওপর খাড়া পাহাড়ের ঝুলে থাকা একটা পাথরের ওপর লাফ দিল। তারপর সেখান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল নিচের নদীতে। সাঁতরে আবার এপাশে এসে নদীর ওপর পাহাড়ের গায়ে একটা গর্তে আশ্রয় নিল নেকড়ে রূপী থিবল্ট। গর্তের মুখটা পানির স্তরের নিচে। গর্তের ভেতরের দিকে চলে গেল ও। অন্তত তিন মাইল পেছনে ফেলে এসেছে কুকুরের পালকে। মিনিট দশেক পর ডাক ছাড়তে ছাড়তে এসে পৌঁছল কুকুরগুলো। উত্তেজনায় হয় খেয়াল করল না সামনে নদী, অথবা ভেবেছিল ওরাও লাফিয়ে ওপাশের পাথরের মাথায় পৌঁছাতে পারবে। কিন্তু কালো নেকড়ের মতো অত জোরে লাফ দেয়া ওদের সাধ্যের বাইরে। ব্যর্থ হয়ে একে একে পানিতে পড়তে লাগল কুকুরগুলো। ছিটকে ওঠা পানি এসে লাগছে থিবল্টের গায়ে। কুকুরগুলো দুর্ভাগা, তার উপর নেকড়ে রূপী থিবল্টের মতো অতটা শক্তিও অবশিষ্ট ছিল না ওদের। নদীর স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারল না ওরা। ঘোড়সওয়ার যতক্ষণে এসে হাজির হলো, ততক্ষণে একে একে সব কুকুরই নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। ব্যারনের শাপ-শাপান্ত শুনতে পেল ও। ব্যারন আর তার শিকারিরা তখন নদীর ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। এই সুযোগে বেরিয়ে এল থিবল্ট। কখনও আঁতরে, কখনও পাথর থেকে পাথরে লাফিয়ে নদীর উৎসের দিকে এগোল। অবশেষে যথেষ্ট দূরত্ব আদায় করা গেছে নিশ্চিত হয়ে একটা গ্রামে ঢুকে পড়ল থিবল্ট। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে দৌড়ে বেড়াল। তারপর পোসিয়ামন গ্রামের কথা মনে পড়ল ও। ওখানে অ্যানলেট আছে। সেদিকে ছুটতে শুরু করল থিবল্ট। সন্ধ্যা ছটা বেজে গেছে। প্রায় পনেরো ঘণ্টা ধরে ধাওয়া চলেছে। না হলেও পঞ্চাশ লীগ১৯ রাস্তা পাড়ি দিয়েছে শিকারি ও শিকার সবাই। সূর্য পাটে বসেছে। সাদা, গোলাপী এবং গোধূলির আরও নানা রঙের শোভা পশ্চিম আকাশে। নানা ফুলের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে, গান গাইছে পাখি। প্রকৃতির এই শান্ত সৌন্দৰ্য্য থিবল্টের ওপর এক অদ্ভুত প্রভাব ফেলল। চারপাশে প্রকৃতি কত সুন্দর, অথচ মানসিক অস্থিরতা ওর ভেতরটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। প্রথম চুক্তির মতো দ্বিতীয় চুক্তিতেও ও ধোঁকা খায়নি তো?
একটা পায়ে চলা পথ দিয়ে এগোতে এগোতে মনে পড়ল, এই পথ দিয়েই প্রথম দিন ও অ্যানলেটকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। আবার অ্যানলেটের ভালবাসা পাবার আশায় ওর মন সজীব হয়ে উঠেছে।
গির্জার ঘণ্টাধ্বনি ভেসে এল থিবল্টের কানে। কালো নেকড়ের মনে পড়ে গেল ওকে তাড়া করে আসা মানুষের কথা। কোন একটা খালি বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার আশায় মাঠের ওপর দিয়ে গ্রামের দিকে দৌড়াল ও। কবরখানার দেয়ালের পাশ দিয়ে যাবার সময় একই রাস্তা দিয়ে আসতে থাকা কিছু লোকের কণ্ঠ শুনতে পেল। মানুষের চোখ এড়ানোর আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে লাফিয়ে দেয়াল পেরোল থিবল্ট। ঢুকে পড়ল কবরখানার ভেতরে। গির্জাটা করবখানার লাগোয়া। দেখাশোনার লোক নেই। লম্বা লম্বা ঘাস জন্মেছে। আরও আছে অযত্নে বেড়ে ওঠা ঝোঁপ-ঝাড়। তেমনি একটা ঘন ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল থিবল্ট। ভেতরে থেকে বাইরে চোখ রাখতে অসুবিধা হবে না। একটা সদ্য খোঁড়া কবর দেখা যাচ্ছে। পাদ্রীর প্রার্থনার আওয়াজও ভেসে আসছে কানে। গির্জার আশেপাশে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছে না ও। কেটে পড়া দরকার-এতক্ষণে রাস্তা পরিষ্কার হয়ে গিয়ে থাকবে বলে আশা করল থিবল্ট।
সবে আড়াল থেকে নাকটা বের করেছে, এমন সময় কবরস্থানের দরজা খুলে গেল। বাধ্য হয়ে আবার লুকিয়ে পড়ল বিল্ট। সাদা পোশাক পরা একটা ছেলে প্রথমে হোলি-ওয়াটার নিয়ে বেরোল। তারপর রূপোর কুশ হাতে একটা লোক এবং সব শেষে পাদ্রীকে দেখা গেল। সবার মুখে মৃতের মঙ্গল কামনা করে করা প্রার্থনা শোনা যাচ্ছে।
চারজন লোক একটা কফিন বয়ে নিয়ে এল। কফিনটা ফুল-লতা-পাতা আঁকা কাপড়ে ঢাকা। যা ঘটছে সবই খুব সাধারণ ঘটনা, তবুও কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে থিবল্টের। সামান্য নড়াচড়াও ওর উপস্থিতি ফাঁস করে দিতে পারে। তাই মূর্তির মতো স্থির হয়ে, উদ্বেগের সাথে কী হয় দেখতে লাগল ও। কফিনটা নামিয়ে রাখা হলো। রীতি অনুযায়ী, কোন তরুণ বা তরুণী যদি খুব অল্প বয়সে মারা যায়, তার কফিন শুধু একটা কাপড়ে ঢেকে কবরের পাশে রাখা হয়। যাতে তার কাছের মানুষেরা শেষ বিদায় জানাতে পারে। এরপর কফিনের ডালা আটকে দিলেই সব শেষ। এক বৃদ্ধাকে ধরে ধরে আনা হলো। দৃশ্যতই মহিলা অন্ধ। মৃতের কপালে একটা চুমু দিতে চাইল সে। কফিনের ওপর থেকে কাপড় সরানো হলো। কফিনে শুয়ে আছে অ্যানলেট! থিবল্টের যন্ত্রণাকাতর মূদ গর গর ধ্বনি উপস্থিত মানুষের কান্নার সাথে মিশে গেল। মৃত অ্যানলেটকে জীবিতকালের চেয়েও সুন্দর লাগছে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থিবল্টের হদয় ভেঙে যাচ্ছে। আর কেউ নয়, মেয়েটাকে ও-ই খুন করেছে। সত্যিকারের দুকুল ছাপানো কষ্ট অনুভব করল থিবল্ট। অনেক অনেক দিন পর নিজের কথা ভাবতে ভুলে গেল ও। ভাবল শুধু মেয়েটারই কথা। যে ওর জীবন থেকে চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে। এমনকি কালো নেকড়ের দেয়া ক্ষমতাও ওকে ফেরত আনতে পারবে না।