শিকারির উদ্দেশে লর্ড ভেকে বলতে শুনল থিবল্ট, তুমি কোন কাজেরই। কুকুরগুলোকে ঠিকমতো বেঁধে আসোনি। ডাকাডাকি করছে। নেকড়েটা যে পালিয়ে গেল। ওটাকে কি আর পাব?
স্বীকার করছি আমার ভুল হয়ে গেছে, মাই লর্ড। গতকালই নেকড়েটাকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছি। ভাবিনি আজ আবার এদিকেই থাকবে ওটা।
তুমি নিশ্চিত এটাই বারবার আমাদের হাত থেকে পালিয়ে গেছে?
গত বছর ম্যাকোট যখন ডুবে গেল, তখন এই নেকড়েটাকেই আমরা তাড়া করছিলাম।
কুকুরগুলোকে ওটার পেছনে লেলিয়ে দেয়া উচিত।
আপনি শুধু হুকুম দিন। রাত শেষ হতে আর দুঘণ্টা বাকি আছে।
যদি একদিন সময় পায়, লেভিলি, তাহলে বহুদূরে চলে যাবে ওটা।
অন্তত ত্রিশ মাইল। মাথা নাড়তে নাড়তে সায় দিল লেভিলি।
এই অভিশপ্ত নেকড়েটাকে কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারছি না। ওর চামড়াটা আমার চাই-ই-চাই! এই চিন্তায় চিন্তায় কোনদিন না পাগল হয়ে যাই আমি!
তাহলে আর দেরি না করে হুকুম দিন, কুকুরগুলোকে ছেড়ে দেই।
ঠিক বলেছ, লেভিলি। নিয়ে এসো হাউন্ডগুলোকে।
দশ মিনিটের মধ্যে ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে কুকুরগুলোকে নিয়ে এল লেভিলি। যদিও লর্ড ভেযের কাছে মনে হলো একহাজার বছর সময় লেগেছে।
ধীরে, ধীরে, লেভিলিকে বলল ব্যারন, এরা নতুন। আগেরগুলোর মতো কড়া প্রশিক্ষণ পাওয়া নয়। বেশি উত্তেজিত হয়ে গেলে কোন কাজে আসবে না। আগে এগুলোর গা গরম করাও।
ছাড়া পাওয়ার পর প্রথমে একটা দুটো করে কুকুর গন্ধ শুঁকে আগানোর চেষ্টা করল। তারপর বাকিগুলোও একে একে যোগ দিল সঙ্গে। বেশ কিছুক্ষণ পর পর ডাকতে লাগল ওগুলো। নেকড়েটা যে পথে গেছে সে পথ আবিষ্কার করার পর বেড়ে গেল ডাকাডাকি।
ভাল সূচনা মানেই অর্ধেক কাজ শেষ! ব্যারনের কণ্ঠে উল্লাস প্রকাশ পেল। লেভিলি, খেয়াল রেখো। আর তোমরা, বাকিদের দিকে ফিরে বলল সে, অনেকবার মার খেয়েছি, আর না। যদি তোমাদের কারও ভুলে সুযোগটা নষ্ট হয়, নেকড়ের বদলে তাকেই কুকুরের ভোগে লাগাব।
উদ্দীপনামূলক বাণী শেষ করে ঘোড়া ছোটাল ব্যারন। হাউন্ডগুলোর কাছাকাছি পৌঁছানোর ইচ্ছা। ওদের ডাকের শব্দ দূর থেকেও শোনা যাচ্ছে।
চতুর্বিংশ অধ্যায় – নেকড়ে-মানব শিকার
ব্লাডহাউন্ডের ডাক শুনেই দৌড় শুরু করায় অনেকদূর এগিয়ে যেতে পেরেছে। থিবল্ট। বেশ কিছুক্ষণ আর কোন আওয়াজ পায়নি, তাই দৌড়ের গতি কমিয়ে দিল ও। তারপর হঠাৎ করেই দূরাগত বজ্রের আওয়াজের মতো ধ্বনি তুলে একসাথে ভেসে আসতে লাগল সবগুলো হাউন্ডের ডাক। এবার কিছুটা উদ্বিগ্ন বোধ করল ও। শত্রুর সাথে দূরত্ব বাড়ানোর জন্য দৌড়ের গতি আবার বাড়িয়ে দিল। বেশ খানিকক্ষণ একটানা ছুটে অবশেষে মন-টেগুতে এসে থামল থিবল্ট। মাথা কাত করে শোনার চেষ্টা করল, নেকড়েতে রূপান্তরিত হওয়ায় ওর শ্রবণশক্তি অনেক বেড়ে গেছে। বুঝতে পারল হাউন্ডগুলো এখনও বেশ দূরে আছে।
পাহাড় থেকে নেমে এল থিবল্ট। ঝাঁপিয়ে পড়ল নদীতে। সাঁতরে গিয়ে উঠল কম্পিয়েইনার তীরে, তারপর ঢুকে পড়ল বনের গভীরে। টানা তিন ঘণ্টা দৌড়েও ওর নেকড়ে পাগুলো ক্লান্ত হয়নি। তবে বনটা অপরিচিত বলে তেমন একটা ভরসা পাচ্ছে না।
আরও মাইলখানেক দৌড়াল থিবল্ট। নদী পেরিয়ে, ঘুরপথে ছুটে আর পিছিয়ে এসে কুকুরগুলোকে ফাঁকি দিতে পেরেছে আশা করা যায়। পিয়েরফে আর মন-গুবের ভোলা প্রান্তর পেরিয়ে শমুতার বনে গিয়ে ঢুকল ও। আরও কিছুদূর ঘুরে একসময় লঙোফোর বনে পৌঁছাল। কিন্তু উ দু পন্ডেউ-এর শেষ মাথায় এসেই হঠাৎ বিশটা কুকুরের একটা দলের মুখোমুখি পড়ে গেল ও। এরইমধ্যে প্রতিবেশীদের সবার কাছে কালো নেকড়েকে তাড়া করার খবর পাঠিয়েছে ব্যারন। তাই মঁসিয়ে দু মন্টবুটোনের শিকারিরা বেরিয়েছে রেকি করতে। নেকড়ে দেখা মাত্র ওরা কুকুরগুলোকে ছেড়ে দিল। শুরু হলো নেকড়ে আর কুকুরের মধ্যে তীব্র বেগে ধাওয়া। ঘোড়া নিয়ে ওদের সঙ্গে তাল মেলাতে অভিজ্ঞ ঘোড়সওয়ারদেরও বেগ পেতে হচ্ছে। বন-প্রান্তর সব পেরিয়ে ধাওয়া চলতে লাগল।
বিদ্যুতের বেগে ধাওয়া চলছে। পেছনে সৃষ্টি হচ্ছে বিশাল ধুলোর মেঘ। শোনা যাচ্ছে শিঙার শব্দ আর চিৎকারের প্রতিধ্বনি। পাহাড়-উপত্যকা, জল কাদা, উঁচু পাথর, সব পেরিয়ে ছুটছে থিবল্ট। ঘোড়া আর কুকুরগুলোরও যেন হিপোগ্রিফের মতো ডানা গজিয়েছে। এদিকে পেছনে ব্যারনও তার দল নিয়ে এসে হাজির। চেঁচিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে কুকুরের পালকে। তবে কালো নেকড়ে এখনও অক্লান্ত ভাবে একই গতিতে দৌড়ে যাচ্ছে। নতুন একপাল কুকুর পেছনে লাগায় একটু দমে গেছে বটে থিবল্ট। কিন্তু এই গতিতে দৌড়ানোর মধ্যেও মানবিক চিন্তা-ভাবনার ক্ষমতা থাকাটা ওর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। যদিও এই যাত্রা নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব কি না জানে না, হয়তো ও মরবে, তবে তার আগে যত কষ্ট আর যন্ত্রণা ওকে সহ্য করতে হয়েছে, তার প্রতিশোধ নিতে হবে। সুখের যত প্রতিশ্রুতি ও পেয়েছে, তা ভোগ করতে হবে। এই অবস্থার মধ্যেও অ্যানলেটের কথা ওর মাথায় এল। অবশ্যই অ্যানলেটের ভালবাসাও ওকে ফিরে পেতে হবে। এখনই হয়তো থিবল্ট আতঙ্কিত, পর মুহূর্তেই আবার রাগান্বিত হয়ে পড়ছে। মাঝেমাঝেই নিজের বর্তমান আকৃতির কথা ভুলে যাচ্ছে। ও। তখন মনে হচ্ছে ঘুরে মুখোমুখি হয় কুকুরগুলোর। রাগে পাগল হওয়ার পরক্ষণেই আবার মৃত্যুভয় জেগে ওঠে। যখন দৌড়ায়, মনে হয় যেন হরিণের পায়ে ছুটছে। যখন লাফায়, মনে হয় ঈগলের মতো পাখা আছে ওর। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। সম্ভাব্য হন্তারকদের তাড়া করার শব্দ দূর হয় না। এই মনে হচ্ছে পেছনে ফেলে এসেছে ওদের, পর মুহূর্তে টের পাচ্ছে যে আরও জোর উদ্যমে কাছে চলে আসছে ধাওয়াকারীর দল। ওর বাঁচার ইচ্ছা মরেনি। শক্তি এখনও শেষ হয়নি। কিন্তু আবার কোন নতুন দলের মুখোমুখি হলে আর উপায় থাকবে না। মরিয়া হয়ে কুকুরগুলোর সাথে দূরত্ব বাড়ানোর জন্য একটা দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল থিবল্ট। ঠিক করল ওর চেনা বনে, ওর ডেরায় ফিরে যাবে। পরিচিত জমিতে কুকুরগুলোকে ফাঁকি দিতে পারবে ও। এই ভেবে আরও একবার দিক পরিবর্তন করল। পিউযো, ভিভিয়ে পেরিয়ে কম্পিয়েইনার বনে ঢুকে পড়ল আবার। তারপর লাগের বন হয়ে অবশেষে ভিলারস-কটেরেটের বনে ফিরে এল কালো নেকড়ে রূপী থিবল্ট। ওর বিশ্বাস এবারে লর্ড ভেযের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে পারবে। কোন সন্দেহ নেই কয়েক জায়গায় সে তার কুকুরদের বসিয়ে রেখেছে সে, কিন্তু ও যে এই দিকে ফিরে আসতে পারে এমন চিন্তা ব্যারনের মাথায় আসার কথা না।