অ্যানলেটের ঘরের দুই মহিলা দেখিয়ে দিল কোন্ দরজা দিয়ে থিবস্ট বেরিয়ে গেছে। তখন লোকজন জড়ো হয়ে ওকে তাড়া করল। তাড়া খেয়ে জঙ্গলের গভীরে পালিয়ে যাবার লক্ষ্যে ছুটতে শুরু করল থিবল্ট।
থিবল্টের আকস্মিক আগমনের ধাক্কায় অ্যানলেটের অবস্থার আরও অবনতি ঘটল। রাত পোহানোর আগেই পাদ্রী ডেকে আনা হলো মুমূর্ষ মেয়েটার জন্য। আর হয়তো কয়েক ঘণ্টা টিকবে ও! মাঝরাতের দিকে পাদ্রী এসে পৌঁছাল। চার্চের লোকেরা ক্রুশ আর ছেলেরা হোলি ওয়াটার বয়ে নিয়ে এল। পাদ্রী গিয়ে বসল ওর মাথার কাছে। তখন কোন এক অদৃশ্য ক্ষমতাবলে অনেকটা শক্তি ফিরে পেল অ্যানলেট। পাদ্রীর সাথে লম্বা সময় ধরে নিচু গলায় কথা বলল মেয়েটা। ওর নিজের আর প্রার্থনার দরকার নেই। কিন্তু তাহলে কার জন্য প্রার্থনা করল ও? সেটা শুধু পাদ্রী, অ্যানলেট আর ঈশ্বরই জানেন।
ত্রাবিংশ অধ্যায় – বর্ষপূর্তি
পেছনের তাড়া করা মানুষদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে আসার পর গতি কমিয়ে দিল থিবল্ট। এখানে বনটা শান্ত। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে, ধাতস্থ হবার জন্য একটা জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়ল ও। আশেপাশে কিছু কালো পাথর ছড়িয়ে আছে। আগুনে পুড়ে কালো হয়ে গেছে ওগুলো। তাহলে কি ভাগ্যের ফেরে ওর পুড়ে যাওয়া কুটিরটার কাছে চলে এসেছে বিল্ট?
কুটিরের সেই শান্তির জীবনের সাথে বর্তমান ভয়ংকর জীবনের তুলনা করে তিক্ততায় ছেয়ে গেল ওর মন। চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পায়ের কাছের কয়লার ওপর পড়ল। দূরে গির্জাগুলোতে একে একে মাঝরাতের ঘণ্টাধ্বনি বাজতে শুরু করেছে।
ঠিক সেই সময়েই মৃত্যুপথযাত্রী অ্যানলেটের প্রার্থনা শুনছে পাদ্রী।
এদিকে নিজের সাথেই কথা বলছে থিবল্ট, দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ ছিলাম আমি। ভাগ্যে ঈশ্বর যা রেখেছেন, তার বাইরে কিছু চাইতে গিয়েছিলাম। সেদিন সেদিনটা ছিল অভিশপ্ত এক দিন! কালো নেকড়ে যেদিন আমাকে অন্যের ক্ষতি করার ক্ষমতা দিল, সেটাও একটা অভিশপ্ত দিন ছিল। ওই ক্ষমতা দিয়ে যা করেছি, তাতে জীবনের সব সুখই ধ্বংস হয়ে গেছে আমার।
পেছনে উচ্চস্বরের একটা হাসি শুনে ফিরে তাকাল বিল্ট। কালো নেকড়েটা নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে! জ্বলন্ত চোখ দুটো ছাড়া বাকি শরীরটা অন্ধকারে ভাল দেখা যাচ্ছে না। থিবল্টের সামনে এসে বসে পড়ল ওটা।
তারপর! মাস্টার থিবল্ট কি অসন্তুষ্ট? মাস্টার থিবন্টকে খুশি করা তো খুব কঠিন দেখা যাচ্ছে।
অসন্তুষ্ট না হবার উপায় কি রেখেছ? তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে ব্যর্থ চাওয়া আর অনিঃশেষ মর্মপীড়া ছাড়া কিছুই পাইনি। ধন-সম্পদ চেয়েছিলাম। সেসব তো পেলামই না, উল্টো যা-ও বা ছিল, তা-ও হারালাম। একটা ঘর ছিল, যে ঘরে শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম। যে ঘর আমাকে রোদ-ঝড় থেকে বাঁচাত। এমনকি সেই ঘরটাও পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সম্মান চেয়েছিলাম। আর এখন? নিম্নবিত্ত মানুষগুলো পর্যন্ত আমাকে মারার জন্য খুঁজছে। ভালবাসা চেয়েছিলাম। একটা মাত্র মেয়ে যে আমাকে ভালবেসেছিল, আমিও যাকে ভালবেসেছিলাম, সে-ও অন্যের স্ত্রী হয়ে গেল। মৃত্যুর মুখে এসে ও এখন আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। তোমার দেয়া বিশাল ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, ওর জন্য আমি কিছুই করতে পারছি না!
শুধু নিজেকে ভালবাসা বন্ধ করো, থিবল্ট।
আমাকে নিয়ে মজা করছ, করো!
তোমাকে নিয়ে মজা করছি না। আমার সাথে পরিচয়ের আগে কি তুমি অন্যের সম্পদের দিকে ঈর্ষার চোখে তাকাওনি?
একটা হরিণের দিকে তাকিয়েছি। অমন শত শত হরিণ বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তুমি কি ভেবেছিলে, একটা হরিণে তোমার চাওয়া শেষ হয়ে যেত? দিনের শেষে রাত আসে আর রাতের শেষে দিন। ঠিক তেমনি, একটা চাওয়া থেকে জন্ম হয় আরেকটা চাওয়ার। হরিণ চেয়েছ, এরপর হরিণটা পরিবেশনের জন্য দামী রূপোর পাত্র চাইতে। সেখান থেকেই জন্ম হত একটা খানসামার চাহিদার। যে তোমাকে খাবার পরিবেশন করবে। উচ্চাকাক্ষা আকাশের মতো, সীমাহীন! মনে হয় দিগন্তরেখার ওপারে এর শেষ আছে, কিন্তু আসলে পুরো পৃথিবীটাকেই ঘিরে আছে এই চাহিদার খেলা। মাদাম পুলের মিলের জন্য তুমি অ্যানলেটকে ত্যাগ করেছিলে। মিলটা পেলে তারপর তুমি মাদাম ম্যাগলোয়ার বাড়িটা চাইতে। কিন্তু মন-গুবের দুর্গ-প্রাসাদ দেখার পর ওই বাড়ির প্রতি তোমার আর কোন আকর্ষণ থাকত না।
তোমার-আমার প্রভু, স্বর্গচ্যুত দেবদূতের সাথে ঈর্ষাকাতরতায় তুমি একই পথের পথিক। পার্থক্য এই যে তুমি ফলটা ভোগ করার মতো বুদ্ধিমান ছিলে না। আর তাই সৎ জীবন যাপন করাটাই তোমার জন্য ভাল হত।
ঠিকই বলেছ, যে ক্ষতি চায় তারই ক্ষতি হয়। আচ্ছা যদি মন থেকে চাই, তাহলে কি আবার আমি সৎ মানুষ হতে পারব না?
জবাবে নেকড়েটা একটা ব্যঙ্গের হাসি হাসল।
শয়তান শুধু মাত্র একটা চুল ধরে টেনে মানুষকে নরকে নিয়ে যেতে পারে। তোমার কয়টা চুলের মালিক এখন সে, বলতে পারো?
না।
সেটা অবশ্য আমিও বলতে পারব না। তবে কটা অবশিষ্ট আছে তা বলতে পারব। তোমার নিজের আর মাত্র একটা চুল বাকি আছে।
কোন মানুষ যখন একটা বাদে আর সব চুলই শয়তানের কাছে হারিয়েছে, তখন সেই অবশিষ্ট চুলটার কল্যাণে ঈশ্বর কি তাকে বাঁচাতে পারে না?
চেষ্টা করে দেখতে পারো।