থিবল্টের কথা বোলো না। চলো, আশেপাশে মানুষজন আছে এমন কোথাও চলো।
হেসে উঠল তরুণ শিকারি। তুমি তো আমার দুর্নাম করিয়ে ছাড়বে! স্বামীরা দেখি কোন কাজেই আসে না। এমনকি স্ত্রীর সাহস জোগানোর জন্যও স্বামীর কোন দরকার নেই!
ঠিকই বলেছ, এটিয়েন। বনের ভেতর দিয়ে একা দৌড়ে আসার সাহস পেয়েছি। আর এখন যে তুমি সাথে আছ তাতে নিশ্চিন্ত বোধ করা উচিত। কিন্তু তারপরও কেন যেন প্রচণ্ড ভয় হচ্ছে আমার।
কী হয়েছে, বলল তো? স্ত্রীকে চুমু খেল এনগুভা।
নেকড়ের আক্রমণ থেকে শুরু করে থিবল্টের সাথে আলাপচারিতা, সব খুলে বলল আনলেট। মন দিয়ে শুনল এনভা, তারপর বলল, চলো, তোমাকে দাদীর কাছে নিরাপদে রেখে আসি। লর্ড ভেষকে জানাতে হবে থিবল্ট কোথায় আস্তানা গেড়েছে।
না, তাহলে তোমাকে বনের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কোথায় কোন্ বিপদ ওঁৎ পেতে আছে কে জানে।
অন্য রাস্তা ধরব আমি। ক্ৰয়োল দিয়ে ঘুরে গেলে বন এড়াতে পারব।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে-মাথা ঝাঁকাল অ্যানলেট। প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে না। এনগুভা পিছু হটবে না। তার চেয়ে বরং ঘরে পৌঁছে আবার অনুরোধ করার জন্য শক্তি সঞ্চয় করা যাক।
তরুণ শিকারি তার কর্তব্যটুকুই শুধু করতে চায়। অ্যানলেটের সাথে থিবল্টের যেখানে দেখা হয়েছে, নিশ্চয়ই তার কাছাকাছিই আছে নেকড়ে নেতা। পরদিন লোক-লস্কর নিয়ে যেদিকে যাবার পরিকল্পনা করছে ব্যারন, সেটা অনেক দূরে। এটিয়েন তাই তাড়াতাড়ি তার মনিবকে খবরটা পৌঁছে দিতে চায়। খুব বেশি রাত আর বাকি নেই, সব ব্যবস্থা করতে সময় লাগবে।
অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল অ্যানলেট। অবশেষে মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে এনগুভাকে বোঝাবার চেষ্টা করল ও। নেকড়ে-মানব হলেও ওর কোন ক্ষতি করেনি থিবল্ট। বরং নেকড়ের কবল থেকে জীবন বাঁচিয়েছে। কোনরকম ক্ষমতা ওর ওপর প্রয়োগও করেনি। অ্যানলেটকে স্বামীর কাছে আসতে দিয়েছে। এখন থিবল্টের অবস্থানের কথা ওর ঘোর শত্রু লর্ড ভেযের কাছে বলে দেয়া বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। অমনটা করা হলে থিবল্ট ঠিকই টের পেয়ে যাবে। এবং এরপর ও আর কাউকে কখনও দয়া না-ও দেখাতে পারে। থিবল্টের হয়ে অনুরোধ করল অ্যানলেট। বিয়ের সময় এনভাকে থিবল্টের কথা সবই জানিয়েছিল ও। অ্যানলেটকে এনগুভা বিশ্বাসও করে। কিন্তু তারপরও সে একটা ঈর্ষার খোঁচা ঠিকই অনুভব করল। সেই প্রথম দিন থিবল্টকে গাছের ওপর আবিষ্কার করার পর থেকেই দুজনের মধ্যে একটা রেষারেষি আছে। অ্যানলেটের কথা মন দিয়ে শুনলেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকল সে। দুজনের মাঝে কে ঠিক-তা নিয়ে তর্ক করতে করতে পথ চলছিল ওরা। থিবল্টের আক্রমণের অত্যাচারে গ্রামে বেড়া দেয়া হয়েছে, গড়ে তোলা হয়েছে টহল বাহিনী। নিজেদের কথায় মগ্ন হয়ে থাকার ফলে এনগুভা এবং অ্যানলেট কেউই পাহারাদারের প্রশ্ন, কে যায়? শুনতে পায়নি। কোন জবাব না পেয়ে পাহারাদার অন্ধকারে ভুলভাল কল্পনা করে ফেলল। বন্দুক তাক করে গুলি করতে উদ্যত হলো সে। এনগুভার চোখে ব্যাপারটা ধরা পড়ল। বন্ধু! বলে চিৎকার করে অ্যানলেটকে আড়াল করে জড়িয়ে ধরল সে। তারপর আর একটা শব্দ না করে কাটা কলা গাছের মতো পড়ে গেল মাটিতে। হৃদপিণ্ড ফুটো হয়ে গেছে ওর।
গুলির শব্দ শুনে সবাই ছুটে এসে এনভাকে মৃত আবিষ্কার করল। ওর লাশের পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে অ্যানলেট। ধরাধরি করে ওকে ওর দাদীর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। কিছুক্ষণ বাদে জ্ঞান ফিরলেও মানসিক স্থিরতা ফিরল না মেয়েটার। পাগলের মতো আচরণ শুরু করল ও। স্বামীর মৃত্যুর জন্য দায়ী করল নিজেকে। অপ্রকৃতস্থ ভাবে স্বামীর আত্মার জন্য শান্তি কামনা করল ও। থিবকে উদ্দেশ্য করেও অনেক অনুরোধ করল। আশপাশে যারা ছিল, ওর করুণ আকুতি শুনতে শুনতে চোখে পানি এসে গেল তাদের।
ধীরে ধীরে ঘটনার বর্ণনা পাওয়া গেল অ্যানলেটের কাছ থেকে। সবাই জেনে গেল, অলৌকিক শক্তি বলে নেকড়ে-মানব এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। তার অভিশাপেই এই দুর্ভাগ্যটা নেমে এসেছে বেচারা এনগুভার উপর। আদপে এটা একটা হত্যাকাণ্ড! থিবল্টের বিরুদ্ধে জনরোষ তাই আরও বেড়ে গেল।
এদিকে কিছুতেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারছে না অ্যানলেট। স্বাস্থ্য ক্রমেই ভেঙে পড়ছে ওর। ডাক্তার-বৈদ্য দেখিয়েও কোন লাভ হয়নি-সব চিকিৎসাই বিফল হয়েছে। সবাই ধরেই নিল অ্যানলেটও শীঘ্রই স্বামীর পথ ধরবে। একমাত্র ওর দাদীর কণ্ঠই ওকে কিছুটা শান্ত করতে পারে। অন্ধ বৃদ্ধা কথা বললেই শুধু ওর দৃষ্টি নরম হয়ে যায়। চোখে জমা হয় অশ্রু। তার হাত কপালে পড়লেই ওর মুখে বিষণ্ণ একটা হাসি ফোটে।
এক রাতে অ্যানলেটের অবস্থার প্রচণ্ড অবনতি হয়েছে। লর্ড ভেযের পাঠানো দুজন মহিলা ওর দেখাশোনা করছে। সম্ভবত কোন দুঃস্বপ্ন দেখে মেয়েটা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে। এমনি সময় হাট করে খুলে গেল ঘরের দরজা। যেন আগুনের শিখায় মোড়ানো একটা মানুষ এসে ঢুকল ভেতরে। বিছানায় উঠে মৃত্যুপথযাত্রী মেয়েটার কপালে চুমু খেয়ে আবার বেরিয়ে গেল সে। এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটল যে ভুল দেখেছে না ঠিক দেখেছে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগল উপস্থিত ব্যক্তিদের। অদৃশ্য কোন কিছুকে উদ্দেশ্য করে অ্যানলেট বলে উঠল, ওকে নিয়ে যাও! ওকে নিয়ে যাও! কিন্তু ততক্ষণে প্রত্যক্ষদর্শী দুজন থিবল্টকে চিনতে পেরেছে। অ্যানলেটের অবস্থার কথা শুনে আর চুপ থাকতে পারেনি থিবল্ট। ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও ছুটে এসেছিল হতভাগ্য মেয়েটাকে দেখতে।