অ্যানলেটের এই পরিষ্কার সিদ্ধান্ত থিবন্টকে ক্ষুব্ধ করে তুলল।
তুমি কি জানো না এই সুরে আমার সাথে কথা বলাটা বোকামি হয়ে যাচ্ছে?
বোকামি হবে কেন?
এখন রাত, আর আমরা এখানে একা। এই সময়ে কেউ স্বপ্নেও এখানে আসার সাহস পাবে না। এখানে আমার যতটা ক্ষমতা আছে, স্বয়ং রাজারও তার রাজ্যে ততটা ক্ষমতা নেই।
মানে?
প্রার্থনার কথা বলছ, আমাকে পাল্টাতে বলছ। আমাকে শাসাচ্ছ?
তোমাকে শাসাব কেন?
যেটা বোঝাতে চাইছি, অ্যানলেটের কথা পাশ কাটিয়ে গেল থিবল্ট। তুমি যা বলেছ-তাতে তোমার প্রতি আমার ভালবাসা যত না বেড়েছে, তোমার স্বামীর প্রতি আমার ঘৃণা বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ভেড়ার জন্য নেকড়েকে ক্ষেপানো বোকামি, যখন নেকড়ের ক্ষমতা ভেড়ার চেয়ে বেশিই হয়।
আমি তোমাকে বলেছি, থিবল্ট, তোমার সাথে দেখা হওয়া নিয়ে আমার ভেতর কোন ভয় কাজ করেনি। অন্যদের বলা কথা মাথায় ছিল বলে হঠাৎ মুহূর্তের জন্য আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এখন তুমি চাইলেও আমাকে ভয় পাওয়াতে পারবে না।
এভাবে কথা বোলো না অ্যানলেট, তুমি চিন্তাও করতে পারবে না শয়তান আমার কানে কী মন্ত্র পড়ছে আর আমাকে কী পরিমাণ পরিশ্রম করতে হচ্ছে সেটা অগ্রাহ্য করার জন্য।
তুমি চাইলে আমাকে মেরে ফেলতে পারো। কিন্তু কাপুরুষের মতো তুমি যা বলছ তা আমি করব না। তুমি আমাকে মেরে ফেললেও আমি আমার স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকব, মরার সময়েও তার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব।
তোমার স্বামীর নামও উচ্চারণ কোরো না, অ্যানলেট। ওর কথা মনে করতে বাধ্য কোরো না আমাকে। নাহলে ওর ক্ষতি করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারব না।
আমাকে তুমি যত খুশি শাসাতে পারো, থিবল্ট, কারণ আমি তোমার সামনে আছি। কিন্তু ও তোমার থেকে অনেক দূরে আছে। এখান থেকে ওর কিছুই করতে পারবে না তুমি।
কে বলেছে তোমাকে? যে ক্ষমতা আমার আছে, তা ঠেকানো আমার পক্ষে কঠিন। কাছে-দূরে সব জায়গায় আমি ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারি।
তাতে আমি হয়তো বিধবা হব। কিন্তু তোমার কি ধারণা? যার কারণে আমি স্বামী হারিয়েছি, তার হাত ধরব?
হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল থিবল্ট, অ্যানলেট, নতুন করে আরও কোন অপরাধ করার হাত থেকে আমাকে বাঁচাও দয়া করে।
তোমার অপরাধের জন্য তুমিই দায়ী, থিবল্ট, আমি নই। আমি তোমাকে আমার জীবন দিতে পারি, কিন্তু সম্মান নয়।
গর্জে উঠল থিবল্ট, ঘৃণা যখন অন্তরে প্রবেশ করে, ভালবাসা তখন পালিয়ে যায়। নিজের খেয়াল রেখ, অ্যানলেট। স্বামীর খেয়াল রেখ। আমার ভেতরে শয়তান আছে। সে আমার মুখ দিয়েই কথা বলে। তোমার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ভালবাসা যখন পেলাম না, প্রতিশোধ নেয়া থেকে নিজেকে চাইলেও বিরত রাখতে পারব না আমি। এখনও সময় আছে। এই হাত ধরো। অভিশাপ থেকে, ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচো। নয়তো এটা জেনো, আমি নই, তুমিই তোমার স্বামীর মৃত্যুর কারণ হবে!
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল থিবল্ট, তারপর অ্যানলেটকে নিরুত্তর থাকতে দেখে বলল, তুমি আমাকে থামালে না অ্যানলেট? তবে তাই হোক! আমাদের তিনজনের ওপরই অভিশাপ নামুক। তুমি, আমি আর সে। আমি চাই তোমার স্বামী মারা যাক, এবং সে মারা যাবে!
তীব্র একটা আর্ত-চিৎকার করে উঠল অ্যানলেট। তবে পরক্ষণেই সামলে নিল নিজেকে। থিবল্ট যা-ই দাবি করুক না কেন, এতদূর থেকে ওর দেয়া অভিশাপ ফলে যাবে এটা অসম্ভব মনে হলো মেয়েটার কাছে। না, না, তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ। বলল ও, আমার প্রার্থনা ওকে সব রকমের বিপদ থেকে বাঁচাবে।
যাও তাহলে, দেখো ঈশ্বর তোমার প্রার্থনার কী জবাব দেয়। একটা কথা, যদি তোমার স্বামীকে জীবিত দেখতে চাও, তাড়াতাড়ি করো। নয়তো শুধু মৃতদেহটাই দেখতে পাবে।
শেষ কথাগুলো যে সুরে বলা হলো, তাতে আনলেটকে একটা আতংক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। থিবল্টের ইশারা করা দিকে ছুট লাগাল ও। একসময় রাতের অন্ধকারে, দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেল মেয়েটা। উচ্চ-নিনাদে কেঁদে উঠল থিবল্ট, আমার আত্মা এখন সত্যিই অভিশপ্ত হয়ে গেল!
দ্বাবিংশ অধ্যায় – থিবল্টের শেষ ইচ্ছা।
প্রাণপণে ছুটে চলেছে অ্যানলেট। দম ফুরিয়ে গেলে থামছে। নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছে-থিবল্টের অভিশাপ আসলে শুধুই একজন ঈর্ষাকাতর মানুষের প্রলাপ মাত্র। কথাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে গেছে, এর কোন ক্ষমতা নেই। দম ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে আবার ছুট দিচ্ছে সে। স্বামীকে আবার না দেখা পর্যন্ত ও শান্তি পাবে না। বন-জঙ্গল পেরিয়ে ছুটে চলেছে ও। নেকড়ের ভয়ও ওকে থামাতে পারছে না। একটাই ভয় কাজ করছে এখন ওর মনে, স্বামীর মৃতদেহ দেখার ভয়। লম্বা পথ দৌড়ে অবশেষে গ্রামের কাছে পৌঁছল অ্যানলেট। চাঁদের রূপালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। অন্ধকার থেকে সেই আলোয় বেরিয়ে আসতেই আড়াল থেকে একজন মানুষ বেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। হাসতে হাসতে বলল, এই রাতের বেলা এত জোরে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছ, মাদাম? অ্যানলেট ওর স্বামীকে চিনতে পারল।
এটিয়েন! স্বামীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল ও। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ! তোমাকে আবার দেখতে পেয়ে আমি যে কী খুশি হয়েছি। তুমি ঠিক আছ তো?
কী ভেবেছিলে, বিবল্ট আর ওর নেকড়েরা আমাকে রাতের খাবার বানিয়েছে।