একটা কেন মা, অনেকগুলো খাব। বলেই মা-কে জড়িয়ে ধরলাম।
তোকে আবার কখন দেখতে পাব?
মোকেট বলল, সন্ধ্যা হবে ফিরতে ফিরতে।
সন্ধ্যায় তুমি তো মাত্রই বললে ভোরে বেরোবে!
যদি নেকড়েটাকে মারতে না পারি, তাহলে নদীর ধারে দুয়েকটা পাখি শিকার করতে নিয়ে যাব।
আচ্ছা! তুমি আমার ছেলেটাকে ডুবিয়ে মারার ধান্ধা করছ।
ঈশ্বর জানেন, আপনি যদি জেনারেলের বিধবা না হতেন, তাহলে বলতাম…
কী? কী বলতে?
বলতাম আপনি ছেলেটাকে এখনও কোল থেকে নামাচ্ছেন না। চিন্তা করুন একবার! আপনার মতো যদি জেনারেলের মা-ও ছেলেকে কোল-ছাড়া না করতেন, তাহলে কি জেনারেল সমুদ্র পেরিয়ে অভিযানে যেতে পারতেন?
ঠিকই বলেছ, মোকেট। আমি আসলেই একটা বোকা। নিয়ে যাও, নিয়ে যাও ওকে।
মা ঘুরে চোখের জল মুছে নিলেন। মায়ের একেকটা অশ্রুবিন্দু, হৃদয়ের একেকটা হীরক খণ্ড, পৃথিবীর আর সব মণির চেয়ে দামী। ছুটে গিয়ে মা-কে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, তুমি না চাইলে আমি যাব না, মা।
না, না মা। মোকেট ঠিকই বলেছে। আজ হোক কাল হোক, তোকে তো দায়িত্ব নেয়া শিখতে হবে।
মা-কে আরেকটা চুমু খেয়ে মোকেটের পিছু নিলাম।
কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। মা রাস্তার মাঝখান পর্যন্ত চলে এসেছেন। যতক্ষণ পারা যায় আমাকে দৃষ্টির সীমানায় রাখতে চাইছেন। এবার আমার চোখ আর্দ্র হয়ে এল।
কী ব্যাপার মঁসিয়ে আলেক্সান্ডার? আপনিও কাঁদছেন!
কী যে বলো না! ঠাণ্ডায় চোখ দিয়ে পানি বেরোচ্ছে।
কিন্তু যে ঈশ্বর অশ্রু দিয়েছেন তিনি জানেন, আমার চোখের পানির কারণ ঠাণ্ডা নয়।
৮
মোকেটের বাড়ি পৌঁছতে অনেক রাত হয়ে গেল। খরগোশের স্টু আর অমলেট দিয়ে রাতের খাবার সেরেছি। মা-কে দেয়া কথা রেখেছে মোকেট। ভাল চাদর আর গরম কাপড় দিয়ে আমার বিছানা করে দিয়েছে।
নিন, শুয়ে পড়ুন। কাল ভোর চারটার দিকে বেরোতে হবে।
যখন তুমি বলবে, তখনই রওনা দেব।
আমি জানি আপনার ঘুম খুব গাঢ়। সকালে হয়তো পানি ঢেলে আপনার ঘুম ভাঙাতে হতে পারে।
বারবার ডাকলেও যদি তাহলে তাই কোরো। দেখা যাক।
তোমার কি ঘুমোবার তাড়া আছে?
কেন? এতরাতে আমাকে দিয়ে কী করাতে চাইছেন?
ভাবছিলাম, ছোটবেলার মতো করে যদি আমাকে গল্প শোনাতে…
আমি যদি মাঝরাত পর্যন্ত আপনাকে গল্প শোনাই, তাহলে রাত দুটোয় আমাকে কে ডেকে দেবে? আমাদের পুরুতমশাই?
তা ঠিক।
যাক, বুঝতে পেরেছেন। বিছানায় যাওয়ার পাঁচ মিনিটের মাথায় মোকেট নাক ডাকা শুরু করল। এপাশ-ওপাশ করে আমার ঘুম আসতে আসতে দুই ঘণ্টা। শিকারের আগে নিঘুম রাত তো কম যায়নি। শেষপর্যন্ত ক্লান্তির কাছে হার মানতে হলো। চারটার দিকে হঠাৎ ঠাণ্ডায় ভেঙে গেল ঘুম। মুখে হাসি নিয়ে মোকেট আমার গায়ের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে দিয়েছে।
কী করছিলে মোকেট?
ডেরাটা খুঁজে পাওয়া গেছে।
নেকড়েটার? কে খুঁজে বের করল?
এই বুড়ো মোকেট!
চমৎকার!
কোথায় লুকিয়েছিল কল্পনাও করতে পারবেন না। তিন ওকের অঞ্চলে।
তাহলে তো আমরা ওকে বাগে পেয়ে গেছি।
আশা করি।
তিন ওকের অঞ্চল জায়গাটা জঙ্গল থেকে শ পাঁচেক পা দূরে একটা সমতল এলাকার মাঝে অবস্থিত। সেখানে অনেক গাছ আর বুনো ঝোঁপ আছে।
বনরক্ষকেরা যাবে?
মএনা, মিদে, ভেটা, লাফুইলে, সেরা সব বন্দুকবাজদের খবর দেয়া হয়েছে। মঁসিয়ে শাপোতি, আপনি আর আমি ভ্যালু থেকে, লানি থেকে মঁসিয়ে হোশদি, লে ফস থেকে মঁসিয়ে দিথু নেল, আর মাঠ রক্ষীরা কুকুরদের সামলাবে। ধরা ওকে পড়তেই হবে, এতে কোন ভুল নেই।
আমাকে ভাল একটা জায়গা বেছে দেবে, মোকেট?
আপনাকে তো বলেইছি আপনি আমার সাথে থাকবেন। তবে সব কিছুর আগে বিছানা ছাড়তে হবে।
একদম ঠিক।
আপনার অল্প বয়স বিবেচনা করে আগুনে কাঠ গুঁজে দিচ্ছি।
তোমার অশেষ দয়া। কথাটা বলার সাহস পাচ্ছিলাম না।
মোকেট কাঠ এনে আগুনে ফেলল। আমি দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম। আমাকে এত তাড়াতাড়ি তৈরি হতে দেখে মোকেটও অবাক হয়ে গেল।
এটা গলায় ঢেলেই রওনা হয়ে যাব আমরা, দুটো গ্লাসে হলুদ রঙের তরল ঢালল। দেখেই বুঝতে পারলাম ওটা কী।
মোকেট, তুমি তো জানো আমি ব্র্যান্ডি খাই না।
আহ, একদম বাবার মতন। তাহলে কী নেবেন?
কিছুই না।
একটা কথা আছে, খালি বাড়িতে শয়তান বাসা বাঁধে। মাদামের আদেশ অনুযায়ী আপনার বন্দুকে গুলি ভরে দিচ্ছি, ততক্ষণে পেটে কিছু দিয়ে নিন।
তাহলে এক টুকরো রুটি আর এক গ্লাস পিনিউলে নেব। পিনিউলে হচ্ছে এক প্রকারের ওয়াইন। জিনিসটা এমন জায়গায় বানানো হয়, যেখানে ওয়াইন তৈরির কাঁচামাল পাওয়া যায় না। খেতে তিনজন লোক লাগে। একজন খায় আর দুজন তাকে ধরে রাখে। আমার অবশ্য কোন অসুবিধা হয় না। খাওয়া শেষ হতে হতে দেখি মোকেটের কাজও শেষ।
কী করছ, মোকেট?
আপনার গুলিতে ক্রুশ চিহ্ন এঁকে রাখছি। আপনি তো আমার পাশেই থাকবেন। একসাথেই গুলি ছুঁড়ব। চিহ্ন থাকলে কার গুলিতে নেকড়েটা মরল বোঝা যাবে। নিশানা সোজা রাখবেন?
আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।
এই যে আপনার বন্দুক, শিকারের জন্য তৈরি। কাঁধে নিন, চলুন বেরিয়ে পড়ি।
৯
পাঁচটার মধ্যেই শভিনি যাওয়ার রাস্তায় সবাই মিলিত হলো। ঠিক হলো-দূরত্ব বজায় রেখে তিন ওকের অঞ্চল নিঃশব্দে ঘিরে ফেলব আমরা। সবাইকে খেয়াল রাখতে বলা হলো যাতে নেকড়েটা পালিয়ে না যায়। এরমধ্যে মোকেটের হাউন্ডগুলোকে সামলে রাখা হবে।