ব্যারন আর থিবল্ট দুজনেই নিষ্ঠার সাথে নিজেদের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিল। কিন্তু ব্যারনের অতিপ্রাকৃতিক কোন ক্ষমতা না থাকায় প্রতিপক্ষকে কাবু করা তার জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ল। তবে লর্ড ভভয যেমন অশান্তিতে আছে, তেমনি নেকড়েদের নেতাও শান্তিতে নেই। যা করছে, তার জন্য নিজেকে দায়ী ভাবে না ও। দায়ী ভাবে তাদেরকে, যাদের জন্য ও বাধ্য হয়েছে এসব করতে। মাঝে মাঝে আনলেট এসে হানা দেয় ওর মানসপটে। অ্যানলেট যেন ওর সুখী জীবনের প্রতীক চিহ্ন! চাইলেই মেয়েটা ওর হতে পারত। ওর মনে হয় অ্যানলেটকে ও এখন আরও বেশি ভালবাসে, এতটা ভাল আর কাউকে বাসা ওর পক্ষে সম্ভব না। কখনও কখনও হারানো সুখের জন্য ওর প্রাণ কেঁদে ওঠে।
জরুরী কাজ পড়ায় একদিনের জন্য শিকারে ক্ষান্ত দিয়ে অন্য দিকে যেতে হলো ব্যারনকে। নেকড়েদের একটু শান্তিতে থাকার সুযোগ মিলল।
গ্রীষ্মের এক সুন্দর সন্ধ্যা। অনেকদিন পর নেকড়েদের সঙ্গ ছেড়ে হাঁটতে বেরোল থিবল্ট। মনে পড়তে লাগল সেই সময়ের কথা যখন কোন সমস্যা বা দুশ্চিন্তা ছিল না। এমনই সময় হঠাৎ একটা আর্ত-চিৎকার কানে এল ওর। ভয়ার্ত কণ্ঠে সাহায্যের আবেদন জানাচ্ছে কে যেন! অন্যসময় হয়তো পাত্তা দিত না, কিন্তু অ্যানলেটের চিন্তায় ওর মনটা তখন নরম হয়ে আছে। এদিকেই মেয়েটার সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল ওর।
শব্দ লক্ষ্য করে দৌড় দিল থিবল্ট। বিশাল এক নেকড়ের আক্রমণ থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে একটা মেয়ে। থিবল্ট বলতে পারবে না কেন, কিন্তু দৃশ্যটা ওকে নাড়া দিল। দৌড়ে গিয়ে ধাক্কা মেরে পশুটাকে সরিয়ে দিল ও। পাজাকোলা করে তুলে নিল অজ্ঞান-প্রায় মেয়েটাকে, তারপর একপাশে এনে সাবধানে নামিয়ে রাখল ঘাসের ওপর। মেয়েটার মুখের ওপর চাঁদের এক ঝলক আলো এসে পড়তে আবিষ্কার করল থিবল্ট-মেয়েটা আর কেউ নয়, অ্যানলেট!
কাছেই বইছে পানির ধারা, সেখানেই প্রথমবার ওর লাল চুলটা দেখেছিল মেয়েটা। আঁজলা ভরে পানি নিয়ে এসে অ্যানলেটের চোখে-মুখে ছিটিয়ে দিল থিবল্ট।
চোখ খুলেই আতংকে চিৎকার দিয়ে পালানোর চেষ্টা করল মেয়েটা। কিন্তু ওকে ধরে ফেলল থিবল্ট, কী হয়েছে? এমনভাবে বলল, যেন এখনও আগের সেই স্যাবট-কারিগর থিবল্টই আছে ও, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না, অ্যানলেট?
কেঁদে উঠে বলল অ্যানলেট, হ্যাঁ, পারছি, থিবল্ট, আর পারছি বলেই ভয় পাচ্ছি।
হাঁটুর ওপর বসে হাত জোড় করল মেয়েটা। আমাকে মেরো না, থিবস্ট! কাঁদতে লাগল ও। দয়া করো! আমাকে মেরো না! আমার বুড়ি দাদী বড় কষ্টে পড়ে যাবে। থিবল্ট, মেরো না আমাকে!
আজকের আগ পর্যন্ত থিবল্টের ধারণা ছিল না মানুষ ওকে কী চোখে দেখে। যে মেয়েটা একদা ওকে ভালবেসেছিল, যাকে ও নিজে এখনও ভালবাসে, তার চোখে ভয় দেখে ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ল নিজের ব্যাপারে।
আমি তোমাকে মারব, অ্যানলেট? আমি! মাত্রই না তোমাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচালাম? ওহ! কতটা ঘৃণা আমাকে করলে তোমার মাথায় এমন একটা চিন্তা আসতে পারে।
আমি তোমাকে ঘৃণা করি না থিবল্ট। কিন্তু তোমার সম্বন্ধে যা শুনি, তাতে তোমাকে ভয় পাই।
তাই? নিশ্চয়ই জঘন্য সব কথা শোন তুমি আমার নামে! কিন্তু কেউ কি বলে না, কেন থিবল্ট এই অন্যায়গুলো করছে?
স্বর্গীয় নীল চোখজোড়া থিবল্টের দিকে তুলে ধরল অ্যানলেট। আমি তোমাকে বুঝতে পারছি না, থিবল্ট।
বুঝতে পারছ না আমি তোমাকে ভালবাসতাম? তোমাকে পূজা করতাম আমি। তোমাকে হারানোর পর আমার সব এলোমেলো হয়ে গেছে।
যদি আমাকে ভালইবাসতে, তবে বিয়ে করতে কী বাধা ছিল?
অশুভ আত্মা!
আমিও তোমাকে ভালবাসতাম থিবল্ট। তোমার অপেক্ষা অনেক কষ্ট দিয়েছে আমাকে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল থিবল্ট, আমাকে ভালবাসতে?
মৃদু স্বরে, নরম চোখে মেয়েটা উত্তর দিল, হ্যাঁ।
কিন্তু এখন সেসব অতীত মাত্র। এখন আর তুমি আমাকে ভালবাসো না।
আমি তোমাকে ভালবাসি না, কারণ তোমাকে ভালবাসাটা এখন অন্যায়। কিন্তু প্রথম ভালবাসাকে কেউ চাইলেও ভুলতে পারে না, থিবল্ট।
অ্যানলেট! কাঁপতে শুরু করল থিবল্ট। কী বলছ বুঝে বলল, মেয়ে!
বোঝাবুঝির কী আছে, যা সত্যি তাই বলছি, সরল মেয়েটা মাথা নাড়ল।
তুমি যেদিন আমাকে বলেছিলে তুমি আমাকে বিয়ে করতে চাও, আমি তোমাকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করেছিলাম। চাবুক পেটা থেকে তোমাকে বাঁচিয়েছি, তারপরও কী করে ভাবব তুমি আমাকে মিথ্যে বলবে? আমি কিন্তু তোমাকে খুঁজতে যাইনি! তুমিই আমার সাথে আবার দেখা করতে এসেছিলে। বলেছিলে ভালবাসার কথা। তুমিই প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলো তোমার আংটিটাকে ভয় পাওয়ার পেছনেও আমার কোন দোষ নেই। তোমার হাতের জন্যও যথেষ্ট বড় ছিল ওটা। অথচ কী ভয়ংকর! আমার কোন আঙুলেই ঢুকল না অভিশপ্ত জিনিসটা!
তুমি কি চাও আমি আংটিটা আমি খুলে ফেলি? ছুঁড়ে ফেলে দেই? বলে আঙুল থেকে ওটা বের করার চেষ্টা শুরু করল থিবল্ট। কিন্তু বিধিবাম! অ্যানলেটের আঙুলে পরানোর সময় যেমন ছোট হয়ে গিয়েছিল, তেমন এখনও তেমনি ছোট হয়ে গেছে আংটিটা। শত চেষ্টাতেও ওটা খুলতে পারল না থিবল্ট।
আংটিটা ভোলা কোনভাবেই সম্ভব না! কানো নেকড়ে আর ওর মাঝের চুক্তিপত্র ওটা। হতাশ হয়ে হাত ছেড়ে দিল থিবল্ট।