হাসছ কেন? জিজ্ঞেস করল একজন।
তোমাদের হাসি বন্ধ হয়ে গেছে দেখে হাসছি।
থিবল্টের কণ্ঠ শুনে আলোর বিন্দুগুলো আরও কাছে চলে এল। পায়ের শব্দ আরও পরিষ্কার শোনা যেতে লাগল। গা শিউরে ওঠার মতো কিছু শব্দ কানে এল ওদের-চোয়াল খোলা আর বন্ধ হবার শব্দ, দাঁতে দাঁত ঘষা খাবার শব্দ।
তো, বন্ধুরা, মানুষের মাংসের স্বাদ তো তোমরা পেয়েছ, এবং তোমাদের ভালও লেগেছে! আলোর বিন্দুগুলোর উদ্দেশে বলল থিবল্ট।
জবাবে আধা-কুকুর আধা-হায়নার মতো মৃদু গরগর ধ্বনি শোনা গেল।
বুঝতে পেরেছি। শিকারির স্বাদ পাওয়ার পর এবার পুলিশের স্বাদ পেতে আপত্তি নেই তোমাদের।
পুলিশেরা এরইমধ্যে ভয়ে কাঁপতে শুরু করেছে। অ্যাই! কার সাথে কথা বলছ তুমি?
যারা আমার ডাকের জবাব দিতে পারে, বলেই নেকড়ের মতো করে ডাক ছাড়ল থিবল্ট। জবাবে বিশটা বা তারও বেশি ডাক শোনা গেল। কিছু খুব কাছে, কিছু খানিকটা দূরে।
এগুলো কি শ্বাপদ? আমাদের পিছু নিয়েছে? এই অকর্মণ্যটা মনে হচ্ছে পশুগুলোর ভাষা বোঝে?
কী মনে হয়! তোমরা রাতের বেলা বনের মধ্যে দিয়ে নেকড়েদের নেতা থিবল্টকে বন্দী করে নিয়ে যাচ্ছ। আর জিজ্ঞেস করছ তোমাদের পিছু নেয়া আলো আর ডাক কীসের? চেঁচাল থিবল্ট, বন্ধুরা শুনেছ? এই ভদ্রলোকেরা জিজ্ঞেস করছে তোমরা কারা? জবাব দাও, একসাথে, যাতে ওদের মনে আর কোন সন্দেহ না থাকে।
নেকড়েরা বাধ্যগতের মতো দীর্ঘ একটা ডাক ছাড়ল। সেই ভয়াবহ শব্দ শুনে ঘোড়াগুলো চঞ্চল হয়ে উঠল। দুয়েকটা পিছিয়েও গেল। পুলিশেরা ভীত সন্ত্রস্ত প্রাণীগুলোকে শান্ত করার প্রয়াস পেল।
এটা তো কিছুই না, অপেক্ষা করো। যখন একেকটা ঘোড়ার পেছনে লাগবে দুটো করে নেকড়ে, আরও, একটা ঘোড়ার গলা কামড়ে ঝুলে থাকবে তখন দেখো।
নেকড়েরা ঘোড়ার পায়ের নিচে চলে এল। থিবল্টের গায়ে গা ঘষতে লাগল ওরা। একটা পেছনের পায়ে দাঁড়িয়ে থিবল্টের বুকে থাবা রাখল। যেন অনুমতি চাইছে।
ধীরে বস, ধীরে। অনেক সময় আছে। স্বার্থপর হয় না। সবাইকে আসতে দাও।
ঘোড়াগুলোকে আর বশে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
একটা চুক্তিতে আসি চলল, থিবল্ট বলল। তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও, তাহলে আজ রাতে নিজের বিছানায় ঘুমাতে পারবে।
আমরা যদি খুব ধীরে আগাই, তাহলে সমস্যা হবে না, বলল এক পুলিশ।
আরেকজনের বুট কামড়ে ধরল এক নেকড়ে। সে তলোয়ার বের করে জানোয়ারটার শরীরে ঢুকিয়ে দিল। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে পড়ে গেল ওটা।
খুব বোকার মতো কাজ করলে। নেকড়েদের নিজেদের মাংস খেতে কোন আপত্তি নেই। একবার রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলে, এমনকি আমিও ওদের ঠেকাতে পারব না।
নেকড়েরা ওদের আহত সঙ্গীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই সুযোগে পুলিশের দল থিবল্টকে নিয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেল। থিবল্ট যা ধারণা করেছিল তা ই হলো। আহত নেকড়েটাকে খেয়ে নেকড়েগুলো ঝড়ের মতো ওদের পিছু ধাওয়া করল।
ঘোড়াগুলো দৌড়ানো শুরু করার পর আর গতি কমাতে রাজি হলো না। সওয়ারিরা যতই চেষ্টা করুক, ভয়ে পূর্ণ গতিতে ছুটছে ঘোড়া। থিবল্টের দড়ি ধরে রাখা পুলিশটাও দড়ি ছেড়ে দিয়ে দুহাতে ঘোড়া সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুরো নেকড়ের পাল ঝাঁপিয়ে পড়েছে ঘোড়াগুলোর ওপর। নেকড়ের দাঁত শরীরে ফোঁটার সাথে সাথে ঘোড়াগুলো দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করল।
থিবল্ট চিৎকার করে নেকড়েগুলোকে উৎসাহ দিচ্ছে। তবে তা না করলেও চলত। একেকটা ঘোড়ার পেছনে পাঁচ-সাতটা করে নেকড়ে জুটে গেছে।
দাঁড়িয়ে পড়ল থিবল্ট। ঘোড়া আর নেকড়েরা একেক দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের আতঙ্কিত চিৎকার, ঘোড়ার যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদ, নেকড়ের ডাক ক্রমেই ফিকে হয়ে আসছে।
থিবল্ট আরও একবার মুক্ত, এবং যথারীতি একা। তবে ওর হাত এখনও বাঁধা। দাঁত দিয়ে বাঁধন কাটার চেষ্টা করল ও, গায়ের শক্তিতে টেনে ছেঁড়ার চেষ্টা করল, কিন্তু দড়ি খুলল না। লাভের মধ্যে দড়ি কেটে বসে যেতে লাগল। চামড়ায়। কোনভাবেই খুলতে না পেরে আকাশের দিকে হাত তুলে ও বলল, কালো নেকড়ে! আমার হাতের বাঁধন খুলে দাও। তুমি তো জানো আমি আরও অনিষ্ট করার জন্যই এই বাঁধন খুলতে চাইছি।
সাথে সাথেই ওর হাত বেঁধে রাখা দড়ি খুলে মাটিতে পড়ে গেল।
একবিংশ অধ্যায় – মেধাবী শয়তান
থিবল্ট ওর ঘরের অবস্থা দেখতে গেল। ছাইয়ের ভগ্নস্তূপ পড়ে আছে। ওর নেকড়েগুলো ধ্বংসস্তূপকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ভঙ্গীতে তীব্র ক্রোধ প্রকাশ পাচ্ছে। ওরা যেন বুঝতে পারছে, কালো নেকড়ের কল্যাণে নেতা হিসেবে যাকে পেয়েছে, এই পোড়াস্থূপের কারণে সে এখন ভুক্তভোগীতে পরিণত হয়েছে। থিবল্ট ওদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। ডেকে উঠে আর অঙ্গভঙ্গি করে থিবন্টকে বলার চেষ্টা করল, প্রতিশোধ নিতে ওকে সাহায্য করবে ওরা।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল থিবল্ট। তাকিয়ে থাকল পোড়া ঘরটার দিকে। অসুখী সব চিন্তারা এসে ভিড় করছে ওর মনে। তবে একবারও এটা ভাবল না, এগুলো ওর ঈর্ষাকাতর উচ্চাকাঙ্ক্ষারই ফলাফল। যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। ওর ভেতর কোন দুঃখবোধ কাজ করল না। বরং এখন সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে যারা ওর ক্ষতি করেছে, তাদের জবাব দিতে পারবে ও।
নেকড়েরা ডাকছে। থিবল্ট বলল, হ্যাঁ বন্ধুরা, তোমাদের ডোক আমার অন্তরের কান্নার জবাব দিচ্ছে। মানুষ আমাদেরকে ঘৃণা করে। ওদের কাছ থেকে আমরা দয়া বা করুণা আশা করতে পারি না। ওরা আমাদের শত্রু। ওদেরও আমরা কোনরকম দয়া বা করুণা দেখাব না। চলো, দুর্গে যাই। যে ধ্বংস ওরা এখানে নিয়ে এসেছে, আমরা সেটাকে আবার ওখানে ফিরিয়ে দিয়ে আসি।