আহ! কী হচ্ছে এসব! মোমবাতিটা নামিয়ে রাখল থিবল্ট। কাঁপা হাতে ওটা আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। কাউন্টেসের দুহাতের মুঠিতে কিছু ধরা আছে মনে হলো ওর। অনেক চেষ্টার পর খুলতে পারল মুঠি দুটো। এক হাতে রয়েছে একটা ছোট বোতল আরেক হাতে এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখা-প্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত! হ্যাঁ, আমৃত্যু স্থিরচিত্ত এবং বিশ্বস্ত। কারণ কাউন্টেস আর বেঁচে নেই!
থিবল্টের সমস্ত কল্পনা একে একে হারিয়ে যাচ্ছে, যেমন করে রাতের স্বপ্ন ভোরে মিলিয়ে যায়।
কপালের ঘাম মুছল থিবল্ট। দরজা খুলে করিডোরে বেরিয়ে এল। লিযেট হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করছে।
কাউন্টেস তাহলে মারা গেছেন?
কাউন্ট, কাউন্টেস দুজনেই।
ব্যারন রাউলের আঘাতের ফলে?
না, কাউন্টেসের ছুরির আঘাতে।
এই পরিস্থিতিতে জোর করে হাসতে গিয়ে মুখ কুঁচকে ফেলল থিবল্ট, তুমি যে গল্পের ইঙ্গিত দিচ্ছ, তা আমার কাছে নতুন।
লিযেট তখন পুরো ঘটনাটা বলল। সরল, কিন্তু হৃদয়বিদারক সে কাহিনী।
প্রায় সারাদিন নিজের ঘরেই ছিল কাউন্টেস। গ্রাম থেকে ভেসে আসছিল ঘণ্টাধ্বনি। ব্যারনের লাশ ভোপাফোতে নেয়া হচ্ছে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করার জন্য। চারটার দিকে ঘণ্টা বন্ধ হলে কাউন্টেস জামার নিচে ড্যাগার লুকিয়ে নিয়ে স্বামীর ঘরের দিকে যায়। কাউন্টের দরজায় দাঁড়ানো পরিচারক খুব খুশি হয় তাকে দেখে। ডাক্তার বলে গেছেন, কাউন্ট এখন বিপদমুক্ত।
মাদাম নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন-এটা আনন্দের খবর।
আনন্দের খবর তো বটেই। বলে স্বামীর ঘরে ঢুকে পড়ে কাউন্টেস। পাঁচমিনিট পরে আবার বেরিয়ে আসে। কাউন্ট ঘুমোচ্ছেন। উনি না ডাকলে ভেতরে যেও না।
মাথা ঝুঁকিয়ে সায় জানায় পরিচারক। তারপর বসে কখন মনিবের ডাক আসে তার অপেক্ষা করতে লাগল।
কাউন্টেস ফিরে গেল নিজের ঘরে। পরিচারিকাকে ডেকে বলল, লিযেট, আমার পোশাক বদলে দাও। ওর সাথে শেষ দেখার সময় যে পোশাক পরে ছিলাম সেগুলো দাও।
হুবহু সেই একই পোশাক পরল কাউন্টেস। তারপর একটা কাগজে কিছু লিখে ডান হাতের মুঠোয় নিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়।
মাদাম, কিছু খাবেন না?
বাঁ হাতের মুঠি খুলে একটা ছোট একটা বোতল দেখাল কাউন্টেস।
খাব, লিযেট, এই বোতলে যা আছে সেটা।
সে কী! আর কিছু খাবেন না?
এটাই যথেষ্ট, লিযেট। এটা খাওয়ার পর আমার আর কোন কিছুর প্রয়োজন পড়বে না। বোতলটা খুলে মুখে উপুড় করে দিল সে। তারপর বলল, লিযেট, গতকাল রাস্তায় যে লোকটার সাথে দেখা হয়েছিল, সে সাড়ে নটার সময় আবার আসবে। তুমি গিয়ে তাকে এখানে নিয়ে এসো। আমি চাই না কেউ বলুক আমি কথা দিয়ে কথা রাখি না। এমনকি সেটা আমার মৃত্যুর পরে হলেও।
থিবল্টের কিছু বলার ছিল না। কাউন্টেস তার কথা রেখেছে। পার্থক্য কাউন্টেস একাই তার প্রতিশোধ নিয়ে ফেলেছে। কাউন্টের পরিচারকের একসময় অস্বস্তি লাগতে শুরু করে। আস্তে করে ঘরের ভেতর উঁকি দেয় সে। এবং দেখে বুকে ছুরি নিয়ে নিথর অবস্থায় পড়ে আছে কাউন্টের মৃত দেহ! আর্ত চিৎকার করে ওঠে সে। তারপর দৌড়ে-মাদামকে জানাতে এসে আবিষ্কার করে যে মাদামও মারা গেছে।
মালিক-মালকিনের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে দুর্গে। মৃত্যু-দেবতা হানা দিয়েছেন, এই ভয়ে চাকর-বাকর সবাই পালিয়ে যায়। শুধু পরিচারিকা লিযেট তার মালকিনের শেষ নির্দেশ পালন করতে রয়ে গেছে।
এখানে থিবল্টের আর কিছু করার নেই। লিযেটকে কাউন্টেসের কাছে রেখে প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে এল ও। আকাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। জানুয়ারি মাস না হলে বলা যেত এটা ঝড়ের পূর্বাভাস। রাস্তায় আলো খুব অল্প। এক-দুবার থেমে দাঁড়াল থিবল্ট। ওর মনে হলো যেন পথের দুপাশে মাটিতে পড়ে থাকা গাছের শাখা ভাঙার শব্দ ভেসে আসছে মাঝে মাঝে।
ভাঙা দেয়ালের কাছে আসা মাত্র থিবল্ট শুনতে পেল, এই সেই লোক! তারপরই চারপাশ থেকে চারজন পুলিশ ওকে চেপে ধরল।
লিজেটের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত হয়ে রাতে টহল দিচ্ছিল খামোজি। তখনই এক অদ্ভুত লোককে ঢুকে আবার বেরিয়ে আসতে দেখে সে। পুলিশকে সেটা জানিয়েও আসে। সাম্প্রতিক নানান দুর্ঘটনার পর একথা শুনে চারজন পুলিশকে পাঠানো হয় সন্দেহজনক কোন লোককে দেখলে ধরে আনার জন্য। খামোজির সংকেত পাওয়া মাত্রই তারা চারজনে মিলে থিবল্টের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
নিরস্ত্র থিবল্টের প্রতিরোধ কোন কাজে আসল না। পুলিশরা ওকে চিনে ফেলেছে। মাটিতে পেড়ে বেঁধে ফেলা হলো ওকে। গত কিছুদিনের ঘটনাবলিতে থিবল্ট অনেক দুর্নাম কামিয়ে ফেলেছে। ওর আশেপাশে প্রচুর দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে। অবশ্য নিজের অশুভ ক্ষমতার বলে চাইলেই পুলিশদেরকে মেরে ফেলতে পারে থিবল্ট। কিন্তু ও অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। একটা ইচ্ছাও যদি
অবশিষ্ট থাকে, বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখলেও, মানুষের বিচার এড়ানো ওর জন্য কোন সমস্যা না।
দড়ি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ওকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল পুলিশেরা। জাদুকর হয়েও কেন থিবল্ট ওদের হাতে ধরা পড়ল তা নিয়ে ব্যঙ্গ করতে লাগল। হাসাহাসি আর বিদ্রূপ চলছে সমানে। থিবল্টের জবাব ছিল একটা প্রচলিত প্রবাদ, শেষ হাসিই সার্থক হাসি। জবাবে পুলিশেরা বলল ওদের ধারণা শেষ হাসিটাও ওরাই হাসবে।
পিউযো পেরিয়ে বনে প্রবেশ করল ওদের দলটা। কালো মেঘ অনেক নিচে নেমে এসেছে। মনে হচ্ছে গাছগুলো কালো চাদর মাথায় দিয়েছে। চার-পা সামনে কী আছে দেখা যায় না। তবে থিবল্ট ঠিকই দেখতে পাচ্ছে যে আশেপাশে অনেকগুলো আলোর বিন্দু ঘোরাফেরা করছে। ক্রমেই কাছে এগিয়ে আসছে সেই বিন্দুগুলো। একসময় শুকনো পাতায় ছন্দময় পদচারণার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। পুলিশদের ঘোড়াগুলো অস্থির হয়ে বাতাসে নাক টানছে। ঘোড়াগুলোকে কাঁপতে দেখে পুলিশদের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। এবার থিবল্টের হাসার পালা।