আমি অপেক্ষা করব।
আগামীকাল তাহলে দেখা হচ্ছে।
হ্যাঁ, আগামীকাল। থিবল্ট চলে গেল। মালাটা রেখে দিল কাউন্টেস। তারপর খুলে ফেলল বাক্সের নিচের লুকানো একটা ঢাকনা। রঙিন তরল ভরা একটা ছোট বোতল আর খাটো একটা ড্যাগার বের করল। রত্নখচিত হাতল আর স্বর্ণালী ফলা ড্যাগারটার। দুটোই বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখল সে। তারপর প্রার্থনা সেরে পোশাক পাল্টে গড়িয়ে পড়ল বিছানায়।
২০. প্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত
বিংশ অধ্যায় – প্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত
কাউন্টেসের সাথে দেখা করে বেরোনোর পর, সত্যিকার অর্থে যাওয়ার কোন জায়গা খুঁজে পেল না থিবল্ট। ঘর পুড়ে গেছে, কোন বন্ধুও নেই। কেইনের মতো পৃথিবীর বুকে সে-ও এখন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবে। শেষ আশ্রয় হিসেবে তাই বনের দিকেই ফিরে গেল। দিনের শেষভাগে বনের কাছে নিঃসঙ্গ একটা বাড়ি চোখে পড়ল থিবল্টের। অর্থের বিনিময়ে একটা রুটি খেতে চাইল সেখানে। বাড়ির কর্তা তখন ঘরে ছিল না। কত্রী রুটি দিলেও টাকা নিতে অস্বীকৃতি জানাল। ওর বেশভূষা মহিলাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। যাই হোক, চলার মতো খাবার পেয়ে বনে ঢুকে পড়ল ও। রাতে বিশ্রাম নেয়ার জন্য পছন্দসই একটা জায়গা খুঁজতে লাগল। হঠাত্র ঢালের নিচে চকচকে কিছু একটা চোখে পড়ল ওর। একটা মৃতদেহের কাঁধের বেল্টে লাগানো রূপোর ব্যাজ। মৃতদেহ না বলে কংকাল বলাই ভাল। লাশটার আশপাশ দেখে মনে হয়। মাত্র গতরাতেই ওখানে ফেলা হয়েছে ওটা, কিন্তু শরীরে কোন মাংস অবশিষ্ট নেই!
নিশ্চয়ই আমার নেকড়েদের কাজ। দেখা যাচ্ছে আমার অনুমতি পেয়ে ওরা ভালই ভোজ সেরেছে!
মৃতদেহটা কার জানার কৌতূহল হলো। ব্যাজে নাম লেখা আছে। খাবার যোগ্য নয় বলে নেকড়েরা ওটা ছুঁয়েও দেখেনি।
ব্যাজটা তুলে দেখল থিবল্ট। জে. বি. লেস্টক! কোঁত দু মন-গুবের লোক।
চমৎকার! হেসে উঠল ও, অবশেষে একজন পাওয়া গেল যে কিনা খুন করে পার পায়নি!
কিন্তু একটা কথা মনে হতেই ভুরু কুঁচকে গেল থিবল্টের। হাসি থামিয়ে নিচু গলায় নিজেকে প্রশ্ন করল ও, তাহলে কি লোকে যেমন বলে, ঈশ্বরের বিচার বলে আসলেই কিছু আছে?
লেস্টক সম্ভবত মনিবের কোন আদেশ পালন করতে মন-গুবে থেকে লোপো যাচ্ছিল। পথে নেকড়ের আক্রমণের শিকার হয় সে। যে ছুরির আঘাতে ব্যারন রাউল নিহত হয়েছে ওই একই ছুরি দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছিল শিকারি। বলা বাহুল্য-সফল হয়নি। একটু দূরেই ছুরিটা খুঁজে পেল থিবল্ট।
থিবল্ট সবকিছুর ব্যাপারে খুব নির্লিপ্ত বোধ করে এখন। লেস্টকের মৃত্যুতে না পেল আনন্দ, না কোন দুঃখ। শুধু এটাই মনে হলো যে কাউন্টেসের কাজটা আরেকটু সহজ হয়ে গেল এতে। এখন শুধু তার স্বামীই বাকি আছে। দিনটা পার করার জন্য একটা পাথরের ছায়া খুঁজে নিল থিবল্ট। দুপুরের দিকে শুনল লর্ড ভেযের শিঙার আওয়াজ। লোকটা আবার শিকারে বেরিয়েছে। তবে থিবল্টের দিনটা নিরুপদ্রবেই কাটল।
রাত নটা বাজতে মন-গুবের দুর্গে হাজির হলো ও। একই জায়গায় অপেক্ষা করছে লিযেট। তবে আজ ওকে শঙ্কিত এবং উৎকণ্ঠিত বলে মনে হলো। আগের মতো মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে গেল থিবল্ট। কিন্তু ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল মেয়েটা।
আমাকে ছোঁবে না, নয়তো আমি চেঁচাব!
আচ্ছা! তা সুন্দরী, আগের দিন ব্যারন রাউলের সাথে তো এমন আচরণ করোনি।
হয়তো না, কিন্তু তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে।
আরও জল গড়াবে, উৎসাহ ফুটল থিবল্টের কণ্ঠে।
হয়তো, শোকাভিভূত গলায় বলল মেয়েটা। তারপর সামনে এগোতে শুরু করে বলল, আসতে চাইলে আমার পেছন পেছন আসো।
আড়াল দিয়ে যাওয়ার কোন চেষ্টাই করল না মেয়েটা।
আজ তোমাকে খুব সাহসী মনে হচ্ছে। কেউ যদি আমাদের দেখে ফেলে…
ভয় নেই, দেখার মতো চোখ সবগুলোই আজ বন্ধ!
কথার অর্থ না বুঝলেও বলার সুরটা শিউরে তুলল ওকে।
ওপরে দরজা খোলার জন্য হাত রাখতে লিযেটকে থামাল থিবল্ট। বাড়িটার নিস্তব্ধতা ওর মনে ভয় ধরিয়ে দিয়েছে। মনে হচ্ছে কারও অভিশাপ পড়েছে জায়গাটার ওপরে।
কোথায় যাচ্ছি আমরা?
তুমি জানো আমরা কোথায় যাচ্ছি।
কাউন্টেসের ঘরে?
হ্যাঁ, কাউন্টেসের ঘরে।
উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন?
হ্যাঁ, তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। ভেতরে যাও। দরজা খুলে দিল লিযেট। তারপর থিবল্ট ভেতরে ঢুকলে দরজা বন্ধ করে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল।
ঘরটা একইরকম আছে। আগের মতোই আলোকিত, সুগন্ধি ভেসে বেড়াচ্ছে। কাউন্টেসকে খুঁজল ও। আশা করল ড্রেসিং রুমের দরজায় এসে দাঁড়াবেন, কিন্তু দরজাটা বন্ধই থাকল। ঘড়ির টিক টিক আর ওর বুকের ধুক ধুক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। একটা অপরিচিত ভয়ের অনুভূতি ওর ভেতরে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে। ভাল করে চারপাশে আরেকবার লক্ষ করতেই চমকে উঠল থিবল্ট-বিছানায় শুয়ে আছে কাউন্টেস! চুলে সেই হীরার পিন লাগানো, গলায় সেই মুক্তোর হারটাও আছে। সে রাতের একই পোশাক তার পরনে। থিবল্ট এগিয়ে গেল, কিন্তু কাউন্টেস নড়ল না।
ঝুঁকে প্রশ্ন করল থিবল্ট, ঘুমাচ্ছেন, কাউন্টেস?
উত্তর নেই! থিবল্টের ঘাড়ের চুল দাঁড়িয়ে গেল। কপালে ঘাম জমল। কাউন্টেস ঘুমাচ্ছে, কিন্তু সেই ঘুম কি এই দুনিয়ার না অনন্তকালের?
কাঁপা কাঁপা হাতে বাতিদান থেকে আলো এনে কাউন্টেসের ঘুমন্ত মুখের ওপর ধরল ও। ফ্যাকাসে মুখ, কপালে শিরার রেখা দেখা যাচ্ছে, আর ঠোঁটটা এখনও লাল। এক ফোঁটা মোম গলে পড়ল ঘুমন্ত মুখের ওপর। কিন্তু ঘুম ভাঙল না মাদামের।