ঘণ্টাটা একবারই বাজল। শব্দটা মিলিয়ে যেতেই আহত লোকটা কাতর আওয়াজ করে উঠল। পাদ্রী উঠে বিছানার পাশে গেল। সাড়ে নয়টা বাজার ঠিক এক সেকেন্ড পর ব্যারন রাউল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।
উনবিংশ অধ্যায় – মৃত এবং জীবিত
ব্যারন যে মুহূর্তে মারা গেল, সেই একই মুহূর্তে ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসল থিবল্ট। চারদিকে আগুন জ্বলছে। কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে? চারপাশে থেকে চিৎকার ভেসে আসছে, নেকড়ে-মানব মরে যাক! জাদুকর নিপাত যাক! না কোন দুঃস্বপ্ন নয়, ওর বাড়ির ওপর আক্রমণ এসেছে।
আর বেশি দেরি করলে জ্যান্ত পুড়ে মরতে হবে। শুয়োর-মারা-বর্শাটা হাতে নিয়ে পেছন দরজা দিয়ে দৌড় দিল থিবল্ট। ওকে দেখার সাথে সাথে আরও জোরে রব উঠল, মারো ওকে! মারো! ওর পাশ দিয়ে কয়েকটা গুলি ছুটে গেল। এরা যে লর্ড ভেযের লোক তাতে কোন সন্দেহ নেই।
আইন আর ওর জন্য প্রযোজ্য নয়। ওকে শেয়ালের মতো আগুন জ্বেলে গর্ত থেকে বের করা যায়। হরিণের মতো ওর উদ্দেশে গুলি ছোঁড়া যায়। সৌভাগ্যক্রমে আগুনটা বেশি ছড়ায়নি, আর কোন গুলিও ওর গায়ে লাগেনি। ছুটে বিশাল অন্ধকার অরণ্যে হারিয়ে গেল ও। দূরে উন্মত্ত জনতার চিৎকার ছাড়া পুরো বন শান্ত। গত আটচল্লিশ ঘণ্টায় এ ঘটনা ঘটেছে, চিন্তা করার মতো বিষয়ের কোন অভাব নেই।
গত চব্বিশটা ঘণ্টা যেন স্বপ্ন ছিল। শপথ করে বলতে পারবে না ঘটনাগুলো সত্যিই ঘটেছে কি না। দশটার ঘণ্টা বাজতেই চমকে উঠল থিবল্ট। মাত্র আধঘণ্টা আগেও ও রাউলের শরীরে ছিল। শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করেছে।
পিউযো এখান থেকে তিনমাইল। যেতে আধঘণ্টা লাগবে। জানা দরকার, ব্যারন শেষ পর্যন্ত বাঁচল না মরল। ওর কথার জবাবেই বাইরে থেকে ভেসে এল বিষণ্ণ ডাক। ওর বিশ্বস্ত অনুচর নেকড়ের দল আবার হাজির হয়েছে।
আয়, আমাদের যেতে হবে। লর্ড ভেযের এক লোক দেখল একজন মানুষ পেছনে ডজনখানেক নেকড়ে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। থিবল্ট যে আসলেই জাদুকর সে বিষয়টা এতে করে আরও সুপ্রতিষ্ঠিত হলো। আরও কেউ যদি থিবকে নেকড়েদের সাথে নিয়ে ওদেরই গতিতে ছুটে যেতে দেখত, তারাও তবে একই কথা ভাবত।
গ্রামের কাছে এসে থামল থিবল্ট। নেকড়েদের দিকে ঘুরে বলল, বন্ধুরা, আজ রাতে আর তোমাদের থাকার দরকার নেই। আমি একটু একা থাকতে চাই। আশপাশের আস্তাবলগুলোতে যা খুশি করতে পারো। দুপেয়ে জীব, যারা নিজেদের মানুষ বলে, দাবি করে তারা ঈশ্বরের প্রতিরূপ; সেসব দাবির কথা ভুলে যাও, যদি কোনটার দেখা পাও, ভয় পেও না। ইচ্ছামতো তোমাদের ক্ষুন্নিবৃত্তি করো! খুশিতে ডাকাডাকি করতে করতে ছড়িয়ে পড়ল নেকড়ের দল। পাদ্রীর বাড়ি গির্জার সাথেই। ক্রুশটাকে এড়ানোর জন্য ঘুরপথে তার বাড়ি গেল থিবল্ট। জানালা দিয়ে উঁকি দিল ভেতরে। ঘরে মোম জ্বলছে। বিছানায় শুয়ে আছে সাদা চাদরের নিচে ঢাকা একটা মানুষ। পাদ্রী সম্ভবত মৃত্যুর খবর কর্তৃপক্ষকে জানাতে গেছে। ঘরে ঢুকল থিবল্ট। বিছানার চাদরটা তুলল। হ্যাঁ, রাউল দু ভোপাফো, কোন সন্দেহ নেই। প্রথম দর্শনে মনে হবে ঘুমাচ্ছে। কিন্তু একটু ভাল মতো দেখলেই মৃত্যুর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।
খোলা দরজা দিয়ে পায়ের শব্দ ভেসে এল। ঘরের পেছনদিকের দরজার সামনে পর্দা ঝুলছে। মৃতদেহটা আবার চাদর ঢাকা দিয়ে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল থিবল্ট। আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা এক মহিলা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়। ঢুকতে ইতস্তত করছে। আরেক মহিলা উঁকি দিয়ে ঘরটা পর্যবেক্ষণ করল।
মাদাম, ভেতরে যেতে পারেন। কেউ নেই মনে হচ্ছে। আমি পাহারায় আছি।
বিছানার দিকে এগোল মহিলা। তাকে চিনতে পারল থিবল্ট, এ আর কেউ নয়, গত রাতে দেখা কাউন্টেস স্বয়ং! কপালের ঘাম মুছতে একবার থামল সে। তারপর তুলে ধরল চাদরটা।
ঈশ্বর! ওরা তাহলে সত্যি কথাই বলেছে! হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল কাউন্টেস। কাঁদতে কাঁদতে প্রার্থনা করছে। বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে গেল এভাবে। অবশেষে দীর্ঘ প্রার্থনার পর সে উঠে দাঁড়াল। উবু হয়ে চুমু খেল মৃত ব্যারনের ক্ষতস্থানে আর কপালে। ওই, রাউল, কে আমাকে তোমার হত্যাকারীর সন্ধান দেবে? কে আমাকে প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করবে? কথাটা শেষ করেই শুনতে পেল, আমি করব! চেঁচিয়ে উঠে পিছিয়ে গেল কাউন্টেস। সবুজ রঙের পর্দাটা দুলে উঠল। কাউন্টেস ভীতু নয়। বিছানার মাথার কাছে রাখা মোমটা তুলে নিয়ে পর্দাটা সরাল সে। আড়ালে কেউ নেই, শুধু ওপাশের দরজাটা খোলা। পকেট বাক্স থেকে কেঁচি বের করল মাদাম। তারপর কেটে নিল প্রেমিকের মাথার এক গোছা চুল। বুকের কাছে ঝুলে থাকা ভেলভেটের থলেটায় রাখল গোছাটা। শেষ একটা চুমু খেয়ে চাদর টেনে বেরিয়ে এল কক্ষ থেকে। চৌকাঠ পেরোবার সময় পাদ্রীর সাথে দেখা হয়ে গেল। পিছিয়ে গিয়ে মুখের নেকাব ভাল করে টেনে দিল। সে।
কে আপনি?
আমি শোক, জবাব দিয়ে পাদ্রীকে কাটিয়ে চলে গেল কাউন্টেস।
পায়ে হেঁটেই এসেছিল কাউন্টেস আর তার সঙ্গী-আবার পায়ে হেঁটেই ফিরে যাচ্ছে। গির্জা থেকে মন-গুবে মাত্র আধ-মাইল। অর্ধেক পথ যাওয়ার পর আড়াল থেকে হঠাৎ তাদের পথ আটকে দাঁড়াল এক লোক। লিযেট চেঁচিয়ে উঠলেও কাউন্টেস জিজ্ঞেস করল, কে তুমি?
আপনি হত্যাকারীর হদিশ জানতে চাওয়ার পর যে বলেছিল আমি করব, সে।