অনেক পরিশ্রমের পর, অনেক ব্যথা সহ্য করে থিবল্ট হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে উঠতে পারল। একটু দূরে মানুষের চলাফেরার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মুখে রক্ত চলে আসায় ডাকতে পারল না। হ্যাট খুলে সেটা ছুরির আগায় ধরে উঁচু করার চেষ্টা করল। তাও শক্তিতে কুলালো না। আবার অজ্ঞান হয়ে গেল ও। একটু পরেই আবার জ্ঞান ফিরল। টের পেল ওর শরীরটা এপাশ-ওপাশ দুলছে। কিছু পথিক ওকে দেখতে পেয়েছে শেষ পর্যন্ত। এই সুদর্শন তরুণটিকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ভিলারস-কটেরেটে। পিউযো পর্যন্ত গিয়ে আহত মানুষটা আর পারল না। কাতর অনুনয় করল কাছাকাছি কোন বাড়িতে ওকে রেখে ডাক্তার ডেকে আনতে। গ্রামের পাদ্রীর বাড়িতে ওকে রেখে গেল ওরা। বিল্ট পার্স থেকে ওদের সোনা বের করে দিল এবং আন্তরিক ধন্যবাদ জানাল। পাদ্রী তখন বাড়িতে ছিল না। ফিরে এসে রাউলকে দেখে প্রচণ্ড দুঃখ প্রকাশ করল সে। রাউল নিজেও হয়তো এরচেয়ে ভাল হাসপাতাল খুঁজে বের করতে পারত না। পাত্রী একসময় রাউলের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছে। আঘাতটা ভাল করে দেখল পাদ্রী। ছুরিটা ডানদিকের ফুসফুসটা ফুটো করে পাজরের ফাঁক দিয়ে বেরিয়েছে।
আঘাতের গুরুত্ব বুঝলেও ডাক্তার না আসা পর্যন্ত কিছু বলল না পাদ্রী। ডাক্তার এসে দেখে মাথা নাড়তে লাগল।
ওর রক্ত বের করবেন?
কী লাভ? আঘাত পাওয়ার পরপরই যদি বের করা যেত, হয়তো উপকার হত। কিন্তু এখন নাড়াচাড়া করাও বিপজ্জনক।
ওর বাঁচার কোন সম্ভাবনা আছে? ডাক্তার যদি হাল ছেড়ে দেয়, তাহলে পাদ্রীর চেষ্টা করার সুযোগ বাড়বে।
ডাক্তার নিচু গলায় বলল, যদি এভাবে চলে, তাহলে আজকের দিনটাও যাবে না।
তারমানে আপনি হাল ছেড়ে দিচ্ছেন?
একজন ডাক্তার কখনও রোগীর ব্যাপারে হাল ছেড়ে দেয় না। দিলেও এই বিশ্বাসটুকু রাখে যে প্রকৃতি রোগীর প্রতি দয়া দেখালেও দেখাতে পারে। ভেতরে কিছু জমাট বাঁধলে রক্তক্ষরণটা বন্ধ হবে। কাশলে আর জমাট বাঁধবে না, তাতে রক্তক্ষরণে রোগীর মৃত্যু হবে।
তাহলে আপনার মতে আমার এখন এই যুবককে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করা উচিত?
ডাক্তার কাধ ঝাঁকিয়ে বলল, সবচেয়ে ভাল হয় ওকে একা থাকতে দিলে। প্রথমত-এখন ও ক্লান্ত এবং ওর শরীরে শক্তি নেই তেমন; আপনার কথায় মনোযোগ দিতে পারবে না। দ্বিতীয়ত-পরে ও পুরোপুরি ঘোরের মধ্যে চলে যাবে, আপনার কথা কিছুই বুঝবে না। কিন্তু থিবল্ট সবই শুনতে পাচ্ছে। লোকে একটা ভুল ধারণা নিয়ে থাকে-মনে করে যে খুব অসুস্থ মানুষ কিছু শুনতে পায় না, কিন্তু মানুষটা সবই শুনতে পায়। অবশ্য থিবল্টের আত্মাটা এই শরীরের নয়। হয়তো এ কারণেই শারীরিক দুর্বলতা সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারছে না ওর ওপর।
পেছনের ক্ষতটা ব্যান্ডেজ করলেও সামনেরটাতে শুধু ঠাণ্ডা পানিতে ভেজা কাপড় দিয়ে রাখতে নির্দেশ দিল ডাক্তার। একটা পানির গ্লাসে ঘুমের ওষুধ মেশাল সে। পাদ্রীকে বলল পানি চাইলে রোগীকে যেন এটা দেয়। পরের দিন সকালে আবার আসবে বলল। যদিও আশঙ্কা করল আসাটা বৃথাই হবে।
থিবল্ট কিছু বলতে চাইলেও শরীরের দুর্বলতার জন্য পারল না। পাদ্রীও ওকে ঝাঁকিয়ে ওঠাবার ব্যর্থ চেষ্টা করল। পাদ্রীর চেষ্টাটা থিবল্টের জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক ছিল। পাদ্রীর ভাগ্য ভাল থিবল্টের অতিমানবীয় ক্ষমতা এখন কাজ করছে না। নয়তো বেচারাকে বহুবার নরক ঘুরে আসতে হত।
একসময় ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গরম লাগতে শুরু করল। শরীরের রক্ত যেন গরম পানির মতো ফুটতে শুরু করেছে। চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আটকে থাকা চোয়াল খুলে গেল। অসার জিভে সার ফিরল।
ডাক্তার যেই ঘোরের কথা বলেছিল, সম্ভবত সেই ঘোরে চলে যাচ্ছি। বেশ অনেকটা সময়ের জন্য এটাই ছিল ওর শেষ স্বাভাবিক চিন্তা।
হরিণের পিছু ধাওয়া থেকে শুরু করে গত রাত পর্যন্ত সব ঘটনা একের পর এক চোখের সামনে ভেসে উঠছে থিবল্টের। কাউন্টেসের হাতে চুমু খাওয়ার পর ও পালাচ্ছে। একটা তেরাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। তিন রাস্তার মাথায় তিনজন মানুষ পাহারা দিচ্ছে। প্রথমজন ডুবন্ত ম্যাকোট। দ্বিতীয়জন হাসপাতালে জ্বরের ঘোরে মৃত্যুপথযাত্রী ল্যান্ড্রি। তৃতীয়জন আহত বিধ্বস্ত এক পা নিয়ে হামাগুড়ি দিতে থাকা একজন মানুষ, কোত দু মন-গুবে।
ও এক এক করে সবার গল্প বলতে থাকল। এই অদ্ভুত স্বীকারোক্তি শুনতে শুনতে একপর্যায়ে আহত লোকটার চেয়েও ফ্যাকাসে হয়ে গেল পাদ্রীর চেহারা। মৃত্যুপথযাত্রী লোকটার চেয়েও বেশি কাঁপছে সে। পাদ্রী ওকে পাপমুক্ত করতে এগোতে চাইলে থিবল্ট তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল। বিচিত্র এক হাসি হেসে উচ্চস্বরে বলল, আমার কোন পাপমুক্তি নেই! আমি অভিশপ্ত। আমার নিয়তি নির্ধারিত!
এই ঘোরের মধ্যেও থিবল্ট ঘড়ির ঘন্টাধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। ঘণ্টা বাজছে আর ও গুনছে। ঘড়িটার আকৃতি হয়ে গেছে বিশাল সংখ্যাগুলো যেন আগুনের শিখা। ঘড়িটা হচ্ছে অনন্তকাল। প্রকাণ্ড পেন্ডুলামটা যেন এপাশ ওপাশ দুলছে আর বলছে, কখনও না। সবসময়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে ও এই লম্বা দিনটা পার করল। এক সময় নটার ঘণ্টা বাজল। সাড়ে নটায় আবার যে যার শরীর ফিরে পাবে। ঘণ্টার শেষ ধ্বনিটা মিলিয়ে যেতেই জ্বরটা চলে গেল। তার পেছন পেছন এক শীতলতার অনুভব। শীতে কাঁপতে লাগল থিবল্ট। চোখ খুলল। পাদ্রী বিছানার পায়ের কাছে বসে প্রার্থনা করছে। ঘড়ির কাটা সময় সোয়া নটা নির্দেশ করছে। সাড়ে নটা বাজতেই প্রবলভাবে শরীরটা কাঁপতে শুরু করল ওর। পা থেকে ধীরে ধীরে সারা শরীর অসাড় হয়ে যেতে শুরু করল। কপালে ঘাম জমছে। না ও নিজে মুছতে পারছে, না কাউকে বলতে পারছে মোছার কথা। অদ্ভুত সব আকৃতি দেখতে পাচ্ছে ও। কোনটাই মানুষের নয়। চোখের আলো মরে আসছে। বাদুড়ের মতো ডানা বের হয়ে ওর যেন শরীরটা উড়ে গেল কোন এক অদ্ভুত জায়গায়, যেখানে গোধূলির মতো আবছা আলো বিরাজ করছে। সেটা না জীবন, না মৃত্যু, দুটোরই অংশ যেন। ধীরে ধীরে অন্ধকার বাড়ছে। চোখ বন্ধ করে অন্ধের মতো হাতড়াচ্ছে ও। ডুবে যাচ্ছে কোন এক অন্তহীন গহ্বরে। শুনতে পাচ্ছে কোথাও একটা ঘণ্টা বাজছে।