তার উপর চুলের ব্যাপারটা তো রয়েছেই! সেই যে এক দার্শনিকের গল্প শুনেছিল। দাবার প্রতি ঘরের জন্য আগের ঘরের দ্বিগুণ গমের দানা চেয়েছিল লোকটা। শেষ ঘরের হিসাব মেলানোর জন্য হাজার বছর ধরে গম চাষ করতে হত। ওর আর কটা ইচ্ছা বাকি আছে? বেশি হলে সাত-আটটা হবে। নিজের দিকে তাকাতে ভয় হলো ওর। অনিশ্চিত ভোরের চেয়ে অনন্ত রাতই ভাল।
ওর যদি ভাল পড়াশোনা থাকত, তাহলে হয়তো অন্যের দুর্ভাগ্য থেকে কীভাবে নিজের সুখ আর সম্পদ অর্জন করা যায় তা বের করতে হবে। শিক্ষিত হলে ডক্টর ফাউষ্টের গল্পটা ওর জানা থাকত। মেফিস্টোফিলিসের কাছ থেকে এত ক্ষমতা পাওয়া সত্বেও তার মতো জ্ঞানী চিন্তাবিদের এই পরিণতি হলো কেন? ভ্যালেন্টিনকে১৩ হত্যা! মার্গারেটের আত্মহত্যা! ট্রয়ের হেলেনের১৫ পেছনে, মিথ্যে ছায়ার পেছনে ছোটা কেন?
থিবল্ট ঈর্ষায় জ্বলছে। অ্যানলেট যখন চিরজীবনের জন্য অন্যের হয়ে যাচ্ছে, তখন যুক্তি দিয়ে চিন্তা করা কি ওর পক্ষে সম্ভব?
তা-ও কার? না, এনওভার। যার কারণে গাছের ওপর ধরা খেয়েছিল ও। যে ঝোঁপ থেকে ওর বর্শাটা খুঁজে বের করেছিল।
আহ! আগে যদি জানত তাহলে ম্যাকোটের বদলে এনগুভার ক্ষতি চাইত থিবল্ট। চাবুকের জ্বালাও এই জ্বালার কাছে কিছু নয়।
উচ্চাকাঙ্ক্ষা এভাবে পেয়ে না বসলে, সুখের একটা জীবন হত ওর। দিনে ছয় ফ্রা আয় করত, আর অ্যানলেটের মতো একটা মেয়ে হত ওর ঘরণী। তখন নিশ্চয়ই অ্যানলেট ওকেই বেশি ভালবাসত। অন্যকে বিয়ে করলেও, অ্যানলেট এখনও হয়তো ওকেই ভালবাসে।
দিন শেষ হয়ে রাত নামতে লাগল।
নবদম্পতির সামর্থ্য যা-ই হোক, এখন নিশ্চয়ই বর-কনে আর অতিথিরা সবাই একসাথে আনন্দ করছে।
আর থিবল্ট এখন একা। খাবার তৈরি করে দেবার মতোও কেউ নেই। খাবার মতোই বা কী আছে? সামান্য রুটি আর পানি। আর যাকে লোকে স্বর্গীয় আশীর্বাদ বলে, সে-ই ভগ্নি, প্রেমিকা বা স্ত্রীর বদলে আছে একরাশ নীরবতা!
তবে সম্পূর্ণ অসহায় নয় থিবল্ট। কে বলেছে ও মন ভরে খেতে পারবে না? মন যা চায়, চাইলেই তা খেয়ে আসতে পারে ও। শিকার বিক্রির টাকাটা তো এখনও ওর কাছেই আছে। বিয়ের অনুষ্ঠানে ওরা যা খরচ করছে, তার চেয়ে বেশিই ও খরচ করতে পারবে। নিজেকে ছাড়া আর কাউকে খুশি করার প্রয়োজন ওর নেই।
আমি একটা গাধা! পেটে ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে ঈর্ষায় জ্বলার কোন মানেই হয় না। ভাল খাবার আর দু-তিন বোতল ওয়াইন হলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব জ্বালা ভুলে যাওয়া যাবে।
ফের্তে-মিলোর পথ ধরল থিবল্ট। ওখানে দোফা-দেঁ নামে একটা চমৎকার রেস্তোরাঁ আছে। ওদের খাবার ডিউকের প্রধান রাধুনীর রান্নার সাথে তুলনা করার মতো।
পঞ্চদশ অধ্যায় – লর্ড ভোপাফে
রেস্তোরাঁয় পৌঁছে ডিনার অর্ডার করল থিবল্ট। চাইলে প্রাইভেট রুম নিতে পারত। কিন্তু ও সবাইকে শুনিয়ে অর্ডার দিল। দামী খাবার, তিন রকমের ওয়াইন। জাহির করতে চাইল নিজেকে।
সামনে আধ বোতল ওয়াইন নিয়ে ঘরের কোনার দিকে একটা লোক বসে ছিল। থিবল্টের গলা শুনে পরিচিত মনে হওয়ায় ঘুরে তাকাল সে। আসলেই থিবল্টের মুখচেনা। একটা গুঁড়িখানায় আলাপ হয়েছিল।
জুতো বানানো ছেড়ে দেয়ার পর থেকে এমন অনেক লোকের সাথেই আলাপ-পরিচয় হয়েছে থিবল্টের। ওকে চিনতে পেরে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল লোকটা। কিন্তু ততক্ষণে লর্ড ভোপাফোঁর চাকর অগাস্ত ফনগোয়াঁ লেভাসোকে চিনে ফেলেছে থিবল্ট।
আরে ফনগোয়াঁ! কোনায় একা বসে কী করছ? এসো, সবার সাথে বসে ডিনার করা।
কোন জবাব না দিয়ে ইশারায় থিবকে চুপ থাকতে বলল।
আমি কথা বলব না? বলব না কথা? কিন্তু যদি আমার কথা বলতে ইচ্ছা করে? একা একা খেতে ভাল না লাগে, তাহলেও বলতে পারব না-ফনগোয়াঁ, বন্ধু আমার, এখানে এসো। আমার সাথে ডিনার করো। করবে না? সত্যিই করবে না? তাহলে আমিই তোমার কাছে আসছি। সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিজের জায়গা ছেড়ে বন্ধুর কাছে গেল থিবল্ট। সজোরে একটা চাপড় বসিয়ে দিল ফনগোয়াঁর কাঁধে।
ভাব দেখাও তুমি ভুল করেছ, থিবল্ট, নয়তো আমার কাজটা মাটি হবে। দেখছ না, আমি ধূসর কোট পরে আছি? মনিবের হয়ে প্রক্সি দিতে এসেছি আমি। এক মহিলার কাছ থেকে একটা চিঠি আসার কথা।
আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তারপরও আপনার সাথে ডিনার করতে পারলে আমার ভাল লাগবে।
ঠিক আছে। আপনি বরং অন্য একটা ঘরে আপনার খাবার দিতে বলুন। আমি রেস্তোরাঁর মালিককে বলে দিচ্ছি, আর কোন ধূসর কোট পরা লোক এলে উপরে পাঠিয়ে দেবে। ওনার সাথে আমার ভাল আলাপ আছে, আশা করি সমস্যা হবে না।
বেশ, থিবল্ট ওর খাবার ওপরে একটা ঘরে নিয়ে যেতে বলল, যেখান থেকে রাস্তা দেখা যায়।
ওপরে বসে অপেক্ষা করতে লাগল থিবল্ট। ও যে খাবার অর্ডার দিয়েছে তা দুজনের জন্য যথেষ্ট। আরও এক বোতল ওয়াইন অর্ডার দিল। এই সময়ে ওয়াইনে ডুবে থাকার পাশাপাশি একজন বন্ধুর সাথে কথা বললে ভাল লাগবে।
ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো। হ্যাটটা মাথায় চেপে বসিয়ে দিল। থিবল্ট। চায় না ফনগোয়াঁ ওর মাথার লাল চুল দেখতে পাক।
বন্ধু, এখন আমাকে বুঝিয়ে বলো তখন কী বললে। আমি পুরোটা বুঝিনি।
তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, চেয়ারে হেলান দিল ফনগোয়াঁ। লর্ডদের চাকরি করতে গেলে দরবারি ভাষা কিছুটা আয়ত্ত করতে হয়। সে ভাষা আবার সবাই বোঝে না।