গাছের গুঁড়ির গর্তটা অনেকটা আরামকেদারার মতো। থিবল্ট সঙ্গী-সাথীদের শুভরাত্রি জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। নেকড়েরা গাছের চারপাশে আর পেঁচারা ডালে জায়গা করে নিল।
সকালে ঘুম ভাঙল থিবল্টের। বৃষ্টি থেমে গেছে অনেক আগে। ওর সঙ্গী সাথীরাও যার যার ডেরায় চলে গেছে।
দূর থেকে বাজনার আওয়াজ ভেসে আসছে। ক্রমেই কাছে চলে আসছে সেই শব্দ। বাজনা শুনে একটা পাখি ডেকে উঠল। মানুষের সুরের জবাবে সৃষ্টিকর্তার সুর। এই শীতে বসন্তের মতো উত্সবের মানে কী?
পাখির ডাক এই উজ্জ্বল, সুন্দর সকালকে স্বাগত জানাচ্ছে। ফুল ওকে দেখতে আসার জন্য সূর্যকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে, তা-ও নিজে উজ্জ্বলতা দিয়ে। প্রকৃতির সাথে মিলে আনন্দ করছে মানুষ। ওদিকে থিবল্টের রাগ আর তিক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। ওর মনের মতো সব যদি অন্ধকার আর বিষণ্ণ হত, তাহলে হয়তো ভাল লাগত থিবল্টের। চলে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু কী একটা শক্তি যেন ওকে আটকে রাখল। গাছের গর্তে লুকিয়ে থাকল ও। আনন্দিত হৈ-চৈ শোনা যেতে লাগল আশপাশ থেকে। কেউ বাজি ফোঁটাল বা বন্দুক ছুঁড়ল। নিশ্চয়ই কোন বিয়ের অনুষ্ঠান। একদল সুসজ্জিত নারী-পুরুষ যাচ্ছে। এর মাঝে লর্ড ভেযের লোকদেরও দেখতে পেল থিবল্ট। এনগুভা, লর্ড ভেযের দ্বিতীয় শিকারি, এক অন্ধ বৃদ্ধাকে হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। থিবল্ট বিস্মিত চোখে কনের দিকে তাকিয়ে রইল। নিজেকে বোঝাতে চাইল ভুল দেখেছে। কিন্তু কাছে আসার পর বুঝতে পারল ভুল দেখেনি। কনে হচ্ছে অ্যানলেট।
অ্যানলেট!
ওর অপমানের মুকুটে আরেকটা পালক। ওর গর্বে বিশাল একটা ধাক্কা। কেউ টেনে-হিঁচড়ে মেয়েটাকে বিয়ের আসরে নিয়ে যাচ্ছে না। অ্যানলেট হাসি মুখে, খুশির সাথে বিয়ে করতে যাচ্ছে।
লেডি ভেযের দেয়া পোশাক এবং গহনায় সজ্জিত হয়ে আছে মেয়েটা।
অ্যানলেটের খুশির কারণ তার হবু স্বামীর প্রতি গভীর প্রেম নয়। ও এমন একজনকে চেয়েছিল যে ওর সাথে ওর অন্ধ দাদীর দায়িত্ব ভাগাভাগি করবে। থিবল্ট সে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বটে, কিন্তু মন থেকে নয়। এখন দেখা যাচ্ছে দায়িত্ব ভাগাভাগি করার মতো মানুষ পেয়ে গেছে অ্যানলেট। ধীরে ধীরে মিছিলটা দূরে চলে যাচ্ছে। সাথে নিয়ে যাচ্ছে বাজনার শব্দ। বেশ অনেকক্ষণ পর বনটা আবার শান্ত হয়ে গেল। কিন্তু থিবল্টের হৃদয়ে আগুন জ্বলছে-ঈর্ষার আগুন।
অ্যানলেটের নিষ্পাপ সৌন্দর্য্যে সুখের ছোঁয়া লেগেছে। গত তিনটা মাস অ্যানলেটের কোন খোঁজ রাখেনি ও। আজ যখন দেখল তখন সে অন্য কারও স্ত্রী হতে যাচ্ছে। মেয়েটাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রাখার কোন রকম অভিপ্রায় থিবল্টের ছিল না। তারপরও সিদ্ধান্তে আসল, অ্যানলেটকে ও সবসময়ই ভালবেসেছে।
নিজেকে বোঝাল, অ্যানলেট ওর প্রতিশ্রুত বাগদত্তা ছিল। এনগুভা ওর অ্যানলেটকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আরেকটু হলে ছুটে যেত ওদের পিছু। এখন। যখন অ্যানলেট আর ওর নয়, তখন মেয়েটা যেন নতুন করে তার সব সৌন্দর্য্য আর গুণ নিয়ে ওর চোখের সামনে হাজির হচ্ছে। শুধু চাইলেই মেয়েটা ওর হতে পারত। অথচ তখন ও বুঝতেই পারেনি।
এতবার প্রতারিত হওয়ার পর নিজের বলতে যে সম্পদটুকু ছিল, তা-ও খুইয়ে বসেছে থিবল্ট। ভেবেছিল যে কোন সময় ফিরতে পারবে আনলেটের কাছে। অন্য কেউ যে সেই সম্পদের দিকে হাত বাড়াতে পারে তেমন ধারণাও কখনও ওর মাথায় আসেনি। দুর্ভাগ্যের চূড়ান্ত ছাড়া একে আর কী-ই বা বলা যায়? হাত কামড়াল থিবল্ট, গাছে মাথা ঠুকল। শেষে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু এ কান্না হৃদয় দ্রবীভূত করার কান্না নয়। হৃদয় থেকে ঘৃণাকে তাড়ানোর ক্ষমতা চোখের এই জলের নেই।
থিবল্ট এখন নিশ্চিত যে অ্যানলেটকে ও ভালবাসে। মেয়েটাকে হারিয়ে ও রাগান্বিত হয়ে উঠেছে। স্বামীসহ মেয়েটার মৃত্যু কামনা করারইচ্ছা ওর ছিল। কিন্তু ঈশ্বরের পরিকল্পনা বোধহয় অন্যরকম। তাই থিবল্টের মনে চিন্তাটা এল না।
কিছুক্ষণ পর কেঁদে ফেলার জন্য লজ্জা বোধ করল থিবল্ট। কান্না সামলানোর চেষ্টা করল। গর্ত থেকে বেরিয়ে পাগলের মতো ঘরের উদ্দেশে ছুট লাগাল। তাতে মন কিছুটা শান্ত হলো। ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল ও।
অতীতে যেমন অনেক মানুষ দুঃখে-কষ্টে জীবন কাটিয়েছে, ভবিষ্যতেও কাটাবে। কেন কিছু মানুষ ক্ষমতা নিয়ে জন্মাবে আর কিছু মানুষ অভাবে?
এত অসাম্য কেন যখন জন্ম সবার একইরকম ভাবে হয়?
প্রকৃতির এই খেলার কোন্ নিয়মে কারও ভাগ্যে সুতো হেঁড়ে, আর কারও ভাগ্যে ছেড়ে না?
একজন ওস্তাদ খেলোয়াড় কি ভাগ্যকে পক্ষে আনার জন্য শয়তানের সাহায্য নেয় না? ও-ও তো সেভাবেই ভেবেছিল।
আর খেলায় চুরির কথা? নিয়ম ভেঙ্গে খেলার চেষ্টা তো করেছিল ও। তাতে কী লাভ হয়েছে? যতবার ভেবেছে এবার ও জিতবে, ততবার জিতে গেছে শয়তান।
অন্যদের ক্ষতি করার এই ক্ষমতা থেকে ও কী পেয়েছে?
কিছুই না।
অ্যানলেটকে হারিয়েছে। মিল মালকিন ওকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বেইলিফের স্ত্রী খেললছে ওকে নিয়ে।
ওর প্রথম ইচ্ছার কারণে বেচারা ম্যাকোট মারা গেল। এমনকি যে হরিণের জন্য এত কাহিনী, সেই হরিণটাও শেষ পর্যন্ত পায়নি। এখান থেকেই ওর হতাশার শুরু। কালো নেকড়ের জন্য হরিণটাকে কুকুরগুলোর কাছে ছেড়ে দিতে হলো।