মাই লর্ড, শান্ত হোন। আপনার ক্রোধের যোগ্য নয় ও। আমি খুবই সাধারণ একজন নাগরিক। ওর বক্তব্যের উপর আমার আর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই আর আমার আতিথেয়তার যে অন্যায় সুযোগ ও নিয়েছে, সেই অপরাধ ক্ষমা করে দিয়েছি আমি।
পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে আনার জন্য এবারে কাঁদতে শুরু করল মাদাম।
কেঁদো না, সুজান, সদয় কণ্ঠে বলল বেইলিফ। তোমার নামে কী অভিযোগ সে আনবে? আমাকে ধোকা দেয়ার? আমাকে যে সুখ তুমি দিয়েছ, তারজন্য তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েই আমি শেষ করতে পারব না। ওর কথায় তোমার প্রতি আমার ভালবাসার কোন পরিবর্তন ঘটবে না। আমি আমার বন্ধুদের জন্য বাড়ির দরজা বন্ধ করতে পারি, কিন্তু তোমার জন্য হৃদয়ের দরজা কখনও বন্ধ করব না। মানুষ খুব ক্ষুদ্র প্রাণী। নিজের ক্ষুদ্রতা স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করাটাই ভাল। খারাপ মানুষদের নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমার বিশ্বাস ওদের সংখ্যাও অনেক কম। দুর্ভাগ্য যদি কখনও দরজা বা জানালা দিয়ে ঢেকেও, উফুল্ল গান-বাজনা আর গ্লাসের ঠোকাঠুকির শব্দে পালাবার পথ পাবে না সে।
বিষণ্ণ দর্শন মিশ্রিত বক্তব্য শেষ হওয়ার আগেই সুজান বেইলিফের পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল, ওর হাতে চুমু খেতে লাগল। বিদগ্ধ পাদ্রীর গভীর ধর্মবোধ সম্পন্ন বক্তব্যও মাদামের ওপর এতটা প্রভাব ফেলতে পারত কি না সন্দেহ। ভেযের লর্ডের চোখের কোণেও জল জমল। সেটা মুছে হাত বাড়িয়ে দিল ব্যারন, বন্ধু, আপনি আসলেই সৎ এবং দয়ালু একজন মানুষ। আপনাকে কোন কষ্ট দেয়াটাও পাপ। অতীতে আমি যদি কখনও আপনার সাথে কোন অন্যায় করার চিন্তাও করে থাকি, ঈশ্বর যেন আমাকে ক্ষমা করেন। তবে এটুকু বলতে পারি, যা-ই ঘটুক, ভবিষ্যতে কখনও এমন চিন্তা আমার মনেও আসবে না।
বিবল্ট বুঝতে পারছে না-ওর মনে অন্ধকারের রাজত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। ক্রমেই ও স্বার্থপর, খারাপ একটা মানুষে পরিণত হচ্ছে। ওর রাগ বাড়তে লাগল। চিৎকার করে বলল, বুঝতে পারছি না, কেন আমি এই নাটকটা বন্ধ করছি না!
বিপদ বুঝতে ব্যারন আর সুজানের দেরি হলো না। ব্যারন আরও একবার তলোয়ার বাগিয়ে এগোতে গিয়ে বেইলিফের বাধার সম্মুখীন হলো।
মাই লর্ড ব্যারন, এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আপনি মনে মনে আমাকে খুন করলেন। চিন্তার দিক দিয়ে আপনি একজন খুনি। সাবধান! পাপ জমাবার অনেক রাস্তা কিন্তু আছে।
শয়তানের দিব্যি! বজ্জাতটা আমাকে নীতিশিক্ষা দিচ্ছে। আপনি একটু আগেও ওকে দ্বি-খণ্ডিত করতে চেয়েছিলেন। এখন আমাকে একবার অন্তত মারতে দিন।
আপনার অনুগত হিসেবে সনির্বন্ধ অনুরোধ করছি, মাই লর্ড। ওকে নিরাপদে যেতে দিন। ও আমার অতিথি, আমার এই গরীবখানায় যেন ওর কোন ক্ষতি না হয়।
তবে তাই হোক। কিন্তু ওর সাথে আমার আবার দেখা হবে। ওর নামে অনেক কথা কানে আসছে। শুধু শুধু চোরাশিকারই ওর একমাত্র অপরাধ নয়, একদল বাধ্যগত নেকড়ের সাথে ঘুরতেও নাকি দেখা গেছে ওকে। আমার ধারণা মাঝরাতে ও জাদুটোনা করে বেড়ায়। ক্রয়োলের মিল মালকিন এরইমধ্যে ওর জাদুটোনার ব্যাপারে অভিযোগ করেছে। ওর ঘর খুঁজে সন্দেহজনক কিছু পেলে জ্বালিয়ে দেয়া হবে। এই এলাকায় জাদুকরের কোন জায়গা নেই। এখন এখান থেকে ভাগ, জলদি!
অন্ধকারেও দেখতে পায় তাই দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে কোন সমস্যা হলো না থিবল্টের। বাড়ি কাঁপিয়ে ওর পেছনে বন্ধ হয়ে গেল দরজা। অহেতুক ইচ্ছা খরচ করে লাল চুলের সংখ্যা বাড়ানোর কোন মানে হয় না, তাই পুরো বাড়িটা জালিয়ে দেয়ার ঝোঁকটা কোনমতে দমন করল বিল্ট। বৃষ্টি শুরু হলো। যদিও বরফ শীতল, তবু ভালই লাগল ওর-মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল।
বেইলিফের বাড়ি পেছনে ফেলে এগোতে লাগল থিবল্ট। একা থাকা দরকার। কখন যেন ক্রয়োলের মিলের কাছে চলে এল। বাড়িটা চোখে পড়তে মিলের মালকিনকে একটা অভিশাপ দিয়ে বনে ঢুকে পড়ল ও।
চতুর্দশ অধ্যায় – বিয়ের অনুষ্ঠান
কিছুদূর যাওয়ার পরই নেকড়েরা ঘিরে ধরল। খুশি হয়ে ওদের কাছে ডেকে আদর করে দিল থিবল্ট। ওরাই হচ্ছে ওর খাস শুভাকাঙ্ক্ষী, ওর আগুনচোখা শিকারি দল। মাথার ওপর রাত-পেঁচার দল ডালে ডালে ডেকে চলেছে। ওদের চোখগুলোও জ্বলন্ত কয়লার মতো। আর এই অশুভচক্রের ঠিক মাঝেই অবস্থান থিবল্টের।
নেকড়েদের মতো পেঁচারাও ওর কাছে উড়ে আসতে লাগল। ওর মাথা ছুঁয়ে কাঁধে বসতে লাগল।
মানুষ আমাকে ঘৃণা করলে কী হবে, পশুপাখি ঠিকই আমাকে ভালবাসে।
সৃষ্টির মধ্যে এই প্রাণীগুলোর অবস্থান কোথায়-সেটা ওর মাথায় নেই। ও ভুলে গেছে-যে প্রাণীগুলো ওকে ভালবাসে, তারা মনুষ্যত্বকে ঘৃণা করে।
প্রাণীজগতের মধ্যে এরা হচ্ছে অন্ধকারের জীব। মানুষের মধ্যে থিবল্টও অন্ধকারের জীবে পরিণত হচ্ছে। তাই ওরা থিবকে ভালবাসছে। এসব প্রাণীর সান্নিধ্যে থেকে ক্ষতি ছাড়া ভাল কিছু করা সম্ভব নয়। ক্ষতি করার কী ভীষণ ক্ষমতা ওর আছে ভেবে হাসল থিবল্ট।
বাড়ি এখনও অনেক দূর। ক্লান্ত লাগছে থিবল্টের। কাছেই একটা কয়েকশো বছরের প্রাচীন ওক গাছ আছে। সেখানে রাতটা কাটানো যেতে পারে। নেকড়েগুলো ওর মন বুঝে পথ না দেখালে পৌঁছতে পারত কি না সন্দেহ। যে গাছ মানুষের আয়ুর চেয়ে দশ, বিশ বা এমনকি তিরিশ গুণ লম্বা সময় ধরে টিকে থাকে, তাদের বয়স দিন-রাতে না…ঋতুতে হিসাব করা উচিত। শরৎ হবে গোধূলি, শীত হলো রাত, বসন্ত ভোর আর গ্রীষ্ম হচ্ছে দিন। চল্লিশ জন মানুষ মিলেও হয়তো প্রাচীন ওক গাছটার বেড় পাবে না।