শুনতে শুনতে ক্লান্ত পথিকের চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, মুখে ফুটে ওঠে হাসি। শৈশবে ফিরতে পারে না সে, তাই শৈশবকেই ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
তে জীবন কি অনেকটা চক্রের মতো নয়? দোলনা থেকে আমরা যাত্রা শুরু করি। কবরের দিকে যত এগোই, ততই আবার দোলনার দিকেই কি ফিরে আসি না?
২
এখন আমি আপনাদের থিবল্ট, ওর নেকড়ের পাল, লর্ড ভেয, আর অ্যানলেটের গল্পটা বলব। গল্পটি আমি শুনেছি মোকেটের কাছ থেকে। মোকেট সম্বন্ধে আমি আরেকটু বিস্তারিত বলব যাতে পাঠক ওকে ভাল করে বুঝতে পারেন।
আমার তখন তিন বছর বয়স। বাবা-মায়ের সাথে লে ফস নামের একটা দুর্গে থাকি। এন আর ওইযের সীমান্তে, আহামো আর লোপোর মাঝে। আমার বোন প্যারিসে থাকত। বছরে একবার মাসখানেকের জন্য বাড়ি আসত।
আমাদের বাড়িতে আরও ছিল ট্রাফল নামে একটা কুকুর-আমি প্রায়ই ওটার পিঠে চেপে ঘুরতাম; মালি পিয়ের-আমাকে খেলার জন্য সাপ ব্যাঙ যোগাড় করে দিত; বাবার নিগ্রো ভ্যালে হিপোলাইট; অতঃপর মোকেট-বাড়ি দেখাশোনা করত; আর ছিল রাধুনী মেরি, যার ব্যাপারে নাম ছাড়া আর তেমন কিছুই অবশ্য আমার মনে নেই।
মোকেট আমাকে নেকড়ে-মানব আর ভূতের গল্প বলত যতক্ষণ না জেনারেল-আমার বাবাকে জেনারেল বলেই ডাকা হত-এসে বাধা দিতেন।
তবে এই কাহিনীর বয়ানে একমাত্র মোকেটই উঠে আসবে, সুতরাং তাকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করা যাক।
৩
মোকেটের বয়স বছর চল্লিশের মতো হবে। ছোটখাটো কিন্তু শক্তপোক্ত গড়নের লোক। মাথায় তেকোনা টুপি, কাঁধে ঝোলা, হাতে পিস্তল আর ঠোঁটে পাইপ।
পাইপটা সম্বন্ধে আরও কিছু কথা বলা এখানে আবশ্যক। ওটা বাহ্যিক একটা বস্তু থেকে বদলে মোকেটের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল। পাইপহীন মোকেটের কথা কেউ স্মরণ করতে পারবে কি না সন্দেহ। কখনও যদি পাইপটা ঠোঁটে না থাকত, তাহলে নির্ঘাত সেটা ওর হাতে থাকবে।
এই সর্বদা পাইপ মুখে চলার ফলে একটা সমস্যা তৈরি হলো। মোকেটের মুখের বাদিকের শ্বদন্তগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে গেল। তাছাড়া পাইপ মুখে আর পাইপ হাতে কথা বলার মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য টের পাওয়া যেত।
এই ছিল মোকেটের বাহ্যিক রূপ। সামনে মোকেটের বুদ্ধিবৃত্তি এবং মানবিক গুণাবলীর কিছু নমুনা পাওয়া যাবে।
৪
একদিন ভোরবেলা। বাবা তখনও বিছানা ছাড়েননি। মোকেট ঘরে ঢুকে পায়ের কাছে খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে গেল।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার মোকেট? এত সকাল সকাল?
জেনারেল, মোকেট গম্ভীর ভাবে বলল, আমি দুঃস্বপ্নিত হচ্ছি। মোকেটের ব্যাকরণজনিত বেশ কিছু ঝামেলা ছিল। ও নিজের অজান্তেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ, দুটো ক্রিয়াপদই একসাথে ব্যবহার করে ফেলে।
তুই দুঃস্বপ্নিত হচ্ছিস? আহারে বেচারা! মোকেটের অনুকরণে জবাব দিলেন বাবা, এ তো খুবই খারাপ কথা। তা কতদিন ধরে হচ্ছিস?
ঠিকই বলেছেন, বেচারাই বটে।
বলে মোকেট দুর্লভ একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে নিল সে। অতীব গুরুত্বপূর্ণ কোন ব্যাপার ঘটলেই কেবল এই কাজটা করে ও।
বাবা সহানুভূতির সুরে জানতে চাইলেন, তা কতদিন ধরে হচ্ছিস?
পুরো এক সপ্তাহ ধরে।
তা কে দেখাচ্ছে দুঃস্বপ্ন?
কে দেখাচ্ছে সেটা খুব ভালমতোই জানি। পাইপটা তখনও ওর হাতে, আর হাতটা পেছনে। তাই যতটা সম্ভব চিবিয়ে চিবিয়ে বলল মোকেট।
তার পরিচয়টা কি জানতে পারি?
আহামোর মাদার ডুরান্ড। নিশ্চয়ই চেনেন, সেই বুড়ি ডাইনিটা।
না রে, অমন কাউকে চিনি না আমি।
ওহ! আমি খুব ভালভাবে চিনি। ডাইনিদের উৎসবে ওকে ঝাড়ুতে করে উড়তে দেখেছি!
ঝাড়ুতে করে উড়তে দেখেছিস?
পরিষ্কার দেখেছি। তাছাড়া ওর বাড়িতে একটা কালো ছাগল আছে যেটাকে সে পূজা করে।
কিন্তু মহিলা কেন এসে তোকে দুঃস্বপ্ন দেখাবে?
প্রতিশোধ নিতে। একদিন মাঝরাতে ওকে শয়তানের চক্রের চারদিকে নাচতে দেখে ফেলেছিলাম।
খুবই গুরুতর অভিযোগ এনেছিস ওর বিরুদ্ধে। আমাকে যা বলেছিস, তা অন্য কাউকে বলার আগে তোর উচিত নিরেট প্রমাণ যোগাড় করা।
প্রমাণ? প্রমাণ কেন লাগবে? গ্রামের সবাই জানে যৌবনে সে নেকড়েদের নেতা থিবল্টের রক্ষিতা ছিল।
ব্যাপারটা আমাকে একটু তলিয়ে দেখতে হবে মোকেট।
আমার দেখা হয়ে গেছে। ওই বুড়ি ছুঁচোকে মাশুল দিতেই হবে!
ছুঁচো শব্দটা মালি পিয়েরের কাছ থেকে ধার করা। বাগানের সবচেয়ে বড় শত্রু ছুঁচো। তাই মালি যাকে বা যেটাকে সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করে, সেটাকেই ছুঁচো বলে গাল দেয়।
বাবা এসব কু-সংস্কারে বিশ্বাস করেন না। এমনকি মোকেটের দুঃস্বরিত হওয়াকেও গুরুত্ব দেননি। কিন্তু তিনি জানতেন এসব গুজবের ফলে অনেক দুঃখজনক এবং নির্মম ঘটনা ঘটেছে। মাদার ডুরান্ডের কথা বলার সময় মোকেট যেভাবে পিস্তলটা চেপে ধরেছিল, তাতে বাবা ভবিষ্যৎ কোন বিপর্যয় এড়ানোর জন্যই তলিয়ে দেখার কথা বলেছেন। যাতে মোকেটের মনে হয়, তিনি কথাটা গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন।
৫
যা-ই হোক, মোকেট। কাউকে দায়ী করার আগে দেখা দরকার, কেউ তোর দুঃস্বপ্ন দেখা বন্ধ করতে পারে কি না? প্রশ্রয় পেয়ে মোকেট কিছুটা প্রভাবিত হয়েছে ভেবে বললেন বাবা।
কেউ পারবে না, জেনারেল, জোর গলায় ঘোষণা করল মোকেট।
কী বলিস! কেউই পারবে না?
কেউ না। অসম্ভব চেষ্টাও করেছি আমি।