অ্যানলেট ওর বাগদত্তা, কিন্তু এই সম্পর্ক ভাঙলে বরং মেয়েটারই ভাল।
আমার মতো সৎ মানুষের উচিত নিজের আনন্দের চেয়ে অন্যের ভালটাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া। অ্যানলেট অল্পবয়সী, মিষ্টি একটা মেয়ে। একজন কাঠ জুতো কারিগরের স্ত্রী হওয়ার চেয়ে অনেক ভাল একজন সঙ্গী ওর প্রাপ্য। আগের দিনের আবেগের বশে করা প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়াটাই উচিত ওর। তারপরই ক্ৰয়োলের বিধবা মিল মালকিনের কথা ওর মনে পড়ল। তার বয়স ছাব্বিশ থেকে আটাশের মধ্যে হবে-সুন্দরী। আর তার মিলটাও কখনও বন্ধ থাকে না, সুতরাং যথেষ্ট অর্থ-সম্পদ আছে বলা যায়। ঠিক এমন একজনকেই দরকার থিবল্টের।
আগে যতবারই মাদাম পুলের কথা ভেবেছে, তখন কোন আশা দেখেনি। কিন্তু নেকড়ের কারণে এখন অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা পেয়েছে ও, সুতরাং এখনকার কথা আলাদা। মাদাম পুলেকে পাওয়ার জন্য ওর প্রতিদ্বন্দ্বীদের হারাতে কোন বেগ পেতে হবে না ওকে। যদিও সবাই বলে মহিলা বদমেজাজি আর হৃদয়হীন। কিন্তু ওইসব ছোটখাটো দোষ সামলানো ওর জন্য এখন কোন বিষয়ই না। সকাল হতেই সিদ্ধান্ত নিল ও, ক্ৰয়োল যাবে।
****
সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল ব্যারনের। বাতাসে চাবুক হাঁকিয়ে বাকিদের জাগাল সে। ম্যাকোটের মৃতদেহটা পাঠিয়ে দিল প্রাসাদে। অন্তত একটা বুনন শুয়োর শিকার করে তারপর নিজে ফিরবে বলে সিদ্ধান্ত নিল। আতিথেয়তার জন্য থিবল্টের সমস্ত দোষ ক্ষমা করে দিল সে।
ব্যারন তার কুকুর আর লোকজন নিয়ে বিদায় নিল। শূন্য ছাউনি, আলমিরা, ভাঙা আসবাব আর ছড়ানো ছিটানো জিনিসপত্র দেখে দুঃখ হলো থিবল্টের। অভিজাতদের চলার পর পথের অবস্থা এমনই হয়! তবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সম্ভাবনা, ওর বর্তমানের দুঃখকে হালকা করে দিল। খুঁজে পেতে শেষ রুটিটা দিয়ে ছাগলের মাংসের শেষ টুকরোটা গলাধঃকরণ করল ও। তারপর ঝর্ণা থেকে পানি খেয়ে তৈরি হয়ে ক্রয়োলের পথ ধরল। নটার সময় বেরিয়ে পড়ল যাতে দিনের আলো থাকতে থাকতেই মাদামের সাথে দেখা করতে পারে।
ক্ৰয়োল যাওয়ার সংক্ষিপ্ত রাস্তা ছেড়ে দীর্ঘ পথ বেছে নিল থিবল্ট। এ পথেই অ্যানলেটের সাথে ওর দেখা হয়েছিল। অবচেতন মন ওকে এদিকেই টেনে এনেছে। আর কী আশ্চর্য! হঠাৎ থিবল্ট দেখতে পেল, পেছন ফিরে ছাগলের জন্য ঘাস কাটছে অ্যানলেট। চাইলে মেয়েটার অলক্ষ্যে চলে যেতেই পারত বটে, কিন্তু ওর ভেতরের শয়তানটা ওকে অ্যানলেটের দিকেই টেনে নিয়ে গেল। টের পেয়ে মুখ তুলে থিবকে দেখতে পেল অ্যানলেট। লজ্জায় রাঙা হয়ে গেল ও, হাসি মুখে উঠে দাঁড়াল।
ও তুমি। কাল রাতে আমি তোমাকে স্বপ্নে দেখেছি, আর তোমার জন্য প্রার্থনা করেছি।
অ্যানলেটের দেবদূতের মতো আকাশে ভেসে যেতে থাকার দৃশ্যটা মনে পড়ল থিবল্টের। আমাকে স্বপ্নে দেখেছ, আমার জন্য প্রার্থনা করেছ, কেন? প্রশ্নে আন্তরিকতার ছোঁয়া কিছুটা কমই ছিল।
মেয়েটা ওর বড় নীল চোখজোড়া তুলল। স্বপ্ন দেখেছি, কারণ, আমি তোমাকে ভালবাসি। আর প্রার্থনা করেছি কারণ, আমি দেখেছি ব্যারন আর তার শিকারিরা কী দুর্ঘটনায় পড়েছিল। তার ফলে তোমাকে কী ভোগান্তিটা পোহাতে হয়েছে, সেটাও আমি জানি। আমার মনের কথা যদি শুনতাম, তাহলে এক ছুটে চলে যেতাম তোমাকে সাহায্য করতে।
হুম, আসলে মন্দ হত না, আমার সঙ্গ পেতে।
এমন সঙ্গ পাওয়ার চেয়ে ব্যারন আর তার লোকদের সামলানোর কাজে তোমাকে সাহায্য করতে পারলে বেশি ভাল লাগত। বাহ! তোমার আংটিটা তো সুন্দর। কোথায় পেলে?
নেকড়ের দেয়া আংটিটা চোখে পড়েছে মেয়েটার। শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল থিবল্টের। এই আংটিটা?
হ্যাঁ, এই আংটিটা, বিবল্ট উত্তর দিতে চাচ্ছে না বুঝতে পেরে মুখ ঘুরিয়ে নিল অ্যানলেট। নিচু স্বরে বলল, নিশ্চয়ই কোন মেয়ে তোমাকে দিয়েছে?
পাকা মিথ্যেবাদীর মতো জবাব দিল ও, ভুল করছ অ্যানলেট, এটা বিয়ের দিন তোমাকে পরাব বলে কিনেছি।
কেন সত্যিটা আমাকে বলছ না?
সত্যি বলছি, অ্যানলেট।
না, মুখ ভার করে মাথা নাড়ল অ্যানলেট।
তোমার কেন মনে হলো আমি মিথ্যে বলছি?
কারণ আংটির ভেতর আমার অন্তত দুটো আঙুল ঢুকবে। থিবল্টের একটা আঙুল আসলেই অ্যানলেটের দুআঙুলের সমান।
একটু বড় হয়তো, কিন্তু ছোট করা যাবে।
বিদায়, মঁসিয়ে থিবল্ট।
কী! বিদায়?
হ্যাঁ।
তুমি চলে যাচ্ছ?
হ্যাঁ, যাচ্ছি।
আপনার মা
কেন, অ্যানলেট?
আমি কোন মিথ্যেবাদীকে ভালবাসি না।
অ্যানলেটকে আশ্বস্ত করার মতো কোন কথাই ওর মাথায় আসল না।
শোনো, চোখে জল অ্যানলেটের। ওরও চলে যেতে কষ্ট হচ্ছে। যদি সত্যিই তুমি এটা আমার জন্য এনে থাকো…
বিশ্বাস করো এটা তোমার জন্য, অ্যানলেট।
তাহলে এটা আমাকে রাখতে দাও। বিয়ের দিন এটা আশীর্বাদের জন্য ফেরত দেব।
আমি এটা তোমার সুন্দর হাতে দেখতে চাই। কিন্তু তুমি ঠিকই বলেছ, এটা আসলেই তোমার হাতের তুলনায় অনেক বড় হয়ে গেছে। আমি আজই মঁসিয়ে দুর্জোর কাছে যাচ্ছি। তোমার হাতের মাপ নিয়ে আংটিটা ঠিক করব।
অ্যানলেটের চোখের জল শুকিয়ে গেল, ফিরে এল মুখের হাসি। নিজের হাত বাড়িয়ে দিল ও। থিবল্ট মেয়েটার হাতটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখল। তারপর চুমু খেল হাতে।
চুমু খাওয়া তোমার ঠিক হয়নি, মঁসিয়ে থিবল্ট, আমার হাত নোংরা হয়ে আছে।