থিবল্ট উপলব্ধি করল, কালো নেকড়ে ওর ইচ্ছাটা ঠিক কীভাবে পূরণ করেছে। বিনিময়টা কখন নেবে সেটা অবশ্য বুঝতে পারছে না ও। ইচ্ছাটা পূরণ হবার পর থেকে এখন পর্যন্ত চুলের গোড়ায় কোন অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছে না। কয়েকটা চুলেই কালো নেকড়ে থেমে যাবে কি না তা-ও বুঝতে পারছে না। ম্যাকোটকে ও দেখতে পারত না বটে। কিন্তু মৃতদেহ দেখে কোনরকম আনন্দও অনুভব করছে না। পছন্দ করার কোন কারণ না থাকলেও, লোকটার মৃত্যু কামনা করেনি ও। আবার এ-ও ঠিক, থিবল্ট পরিষ্কার করে কিছু বলেনি। ভবিষ্যতে ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে ওকে।
ব্যারনও মৃতবৎ পড়ে আছে। ম্যাকোটের মৃতদেহ দেখার পর থেকে আর তার জ্ঞান ফেরেনি। ঘাসের স্তূপে এনে ব্যারনকে শোয়াল ওরা। জ্ঞান ফেরানোর মতো কিছু পাওয়া যায় কি না খুঁজতে লাগল সবাই। কেউ ভিনেগারের কথা বলল, কেউ বলল অম্নের কথা। এরমধ্যে এনগুভার গলা শোনা গেল, এসব কিছুই না, একটা ছাগল দরকার। যদি একটা ছাগল পাওয়া যেত।
ছাগল? ব্যারনের জ্ঞান ফিরলে নিজেকে কিছুটা ভারমুক্ত মনে করতে পারত থিবল্ট। আমার একটা ছাগল আছে!
সত্যি! আছে? যাক, মাই লর্ডকে এখন বাঁচানো যাবে। খুশিতে থিবকে। জড়িয়ে ধরল এনগুভা। নিয়ে এসো তোমার ছাগল, বন্ধু!
থিবল্ট ছাউনি থেকে ছাগলটাকে নিয়ে এল।
ওটার শিংগুলো শক্ত করে ধরো, আর সামনের একটা পা ভোলো। আরেক শিকারি একটা ছুরি বের করে ধার দেয়া শুরু করল।
তোমরা কী করবে? প্রস্তুতি দেখে অস্বস্তিতে পড়ে গেল থিবল্ট।
কেন? তুমি জানো না! ছাগলের হৃদপিণ্ডের কাছে ক্রুশের আকৃতির একটা হাড় আছে। ওটাকে গুড়ো করতে পারলে, তার মতো দাওয়াই আর হয় না।
ছাগলটার শিং আর পা ছেড়ে দিয়ে থিবল্ট জিজ্ঞেস করল, তোমরা আমার ছাগলটাকে মেরে ফেলতে চাইছ?
ছি, ছি! মঁসিয়ে থিবল্ট, এটা কোন কথা হলো। আমাদের ব্যারনের জীবনের চাইতে এই ছাগলটার জীবনের দাম তোমার কাছে বেশি হলো? খুবই লজ্জার ব্যাপার।
তোমার জন্য বলা খুব সহজ। আমার নিজের বলতে এই ছাগলটাই আছে। ওর উপর আমি নির্ভর করি। আমাকে নিয়মিত দুধ দেয় ও। তাছাড়া একটা মায়াও পড়ে গেছে।
মঁসিয়ে থিবল্ট, এভাবে তোমার চিন্তা করা উচিত হচ্ছে না। ব্যারন যদি শুনতে পেতেন ওনার জীবন নিয়ে এভাবে দর কষাকষি হচ্ছে, উনার হৃদয় ভেঙে যেত।
আরেকজন বাঁকা হাসি হেসে বলল, ওর যদি মনে হয় ছাগলের দাম শুধু ব্যারনই মেটাতে পারবেন, তাহলে ও দুর্গে আসুক। গতকাল যে হিসাবটা বাকি ছিল, ওটা দিয়ে না হয় দাম মেটানো যাবে।
এদের সাথে এখন শক্তিতে পারবে না, তাছাড়া এখন শয়তানকেও ডাকতে চায় না ও। এটা বুঝে গেছে, ওর সংশ্লিষ্টতার কোন প্রমাণ নেই। এখানে যারা আছে, তাদের কারো আর কোন ক্ষতি চায় না গিবল্ট।
একজন মারা গেছে, আরেকজন মৃতপ্রায়-যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে ওর। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য মুখ ঘুরিয়ে রাখল ও। অসহায়ভাবে ডাকতে থাকা ছাগলটার গলা কেটে হৃদপিণ্ড উন্মুক্ত করে হাড়টা খুঁজে বের করল ব্যারনের লোকেরা। হাড়টা গুড়ো করে ভিনেগার আর অন্য দুয়েকটা জিনিস দিয়ে একটা মিশ্রণ তৈরি করা হলো। তারপর ছুরি দিয়ে দাঁত ফাঁক করে ওটা খাইয়ে দেয়া হলো ব্যারনকে।
জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হলো। নাক ঝেড়ে উঠে বসল ব্যারন। ফ্যাসফ্যাসে গলায় পানীয় চাইল।
এনভা একটা কাঠের কাপে পানি এনে দিল। কাপটা থিবল্টের পারিবারিক সম্পত্তি। ঠোঁটে লাগানো মাত্র ব্যারন টের পেল কী পানীয় তাকে দেয়া হয়েছে। রাগে কাপটা ছুঁড়ে ফেলল সে। বাড়ি লেগে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল ওটা। ওয়াইন চাইল ব্যারন। একজন ঘোড়ায় চড়ে দুর্গে গিয়ে দুটো বোতল নিয়ে এল। আর কোন কাপ না পাওয়ায় বোতল দুটোই পালা করে গলায় ঢালল ব্যারন।
তারপর বিড়বিড় করতে করতে দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
ষষ্ঠ অধ্যায় – অভিশপ্ত চুল
ব্যারনের স্বাস্থ্য নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটার পর, তার লোকেরা হাউন্ডগুলোর খোঁজে গেল। ওগুলোকে পাওয়া গেল ঘুমন্ত অবস্থায়। চারপাশে রক্তের দাগ। বোঝ গেল-ওরা হরিণটাকে ধরতে পেরেছিল। হরিণটার শরীরের দুয়েকটা অবশিষ্টাংশও আশেপাশে পাওয়া গেল। কুকুরগুলোকে ছাউনিতে আটকে রাখা হলো। তখনও ব্যারনের ঘুম ভাঙেনি দেখে, লোকগুলো থিবল্টের ঘরে খাওয়ার মতো যা ছিল, জড়ো করল সব। ছাগলটাকেও রান্না করে ডাকল থিবল্টকে। কিন্তু থিবল্ট জানাল ব্যারন আর ম্যাকোটের অবস্থা দেখে ওর খিদে নষ্ট হয়ে গেছে।
ভেঙে যাওয়া কাপটা তুলল ও। ওটাকে জোড়া লাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। গত দুদিনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ওর অবস্থা বেশ নাজুক। এখান থেকে পরিত্রাণের জন্য কী করা ওর পক্ষে সম্ভব ভাবতে লাগল। তখন আনলেটের মুখটাই প্রথম ওর মনের পর্দায় ভেসে উঠল। ছোট বাচ্চারা স্বপ্নে যে রূপে দেবদূতদের দেখে, অনেকটা সে রূপে। অ্যানলেটের গায়ে সাদা রঙের পোশাক, পিঠে সাদা রঙের বিশাল ডানা, নীল আকাশের বুকে ভেসে যাচ্ছে। ওকে খুব সুখী মনে হচ্ছে। পিছু নিতে ইশারা করছে ও, বলছে, যারা আমার সাথে আসবে, তারা সুখী হবে। কিন্তু থিবল্ট যে উত্তরটা খুঁজে পেল তা হলো ভিন্ন, হ্যাঁ অ্যানলেট, গতকাল পর্যন্ত তোমাকে অনুসরণ করলে ঠিক ছিল। কিন্তু আজ আমি রাজার মতো জীবন-মৃত্যুর অধিকারী। মাত্র একদিন বয়সী ভালবাসার পেছনে ছোটার মতো বোকা আমি নই। তোমাকে বিয়ে করার মানে জীবনের অভাব অভিযোগকে দ্বিগুণ-তিনগুণ করা। না অ্যানলেট, তুমি প্রেমিকা হতে পারো; কিন্তু স্ত্রী হবে এমন কেউ-যে অর্থ নিয়ে আসবে। আর আমার তো ক্ষমতা রইলই।