কথাটা একেবারে ভুল বলোনি।
প্রতিবেশী, সে তোমার বন্ধু হোক বা শত্রু, তার ক্ষতিতে লাভবান হবার সুযোগ তো থাকেই।
উত্তর দেয়ার আগে একটু ভেবে নিল থিবল্ট, খুব একটা ভুল বলোনি তুমি। ঠিক আছে, আমি রাজি। কিন্তু এর বিনিময়ে আবার নিশ্চয়ই কিছু চাইবে। কী চাও?
অবশ্যই। প্রতিবার তোমার কোন এমন একটা ইচ্ছা, যাতে তোমার তাৎক্ষণিক কোন উপকার হচ্ছে না, তাহলে সেটা পূরণ করার বিনিময়ে তোমার শরীরের কিছু একটা আমি নেব।
আতঙ্কের চিহ্ন ফুটে উঠল থিবল্টের চেহারায়।
ভয় পেও না। আমার চেনা জানা এক বিশেষ ইহুদীর মতো ঋণগ্রহীতার শরীরের মাংস চাইব না।
তাহলে কী চাও?
তোমার প্রথম ইচ্ছাপূরণের জন্য একটা চুল, দ্বিতীয় ইচ্ছা পূরণের জন্য দুটো, তৃতীয়টার জন্য চারটা। এভাবে প্রতিবার আগেরবারের দ্বিগুণ হবে।
থিবল্ট হেসে ফেলল, ওহ, এইই। তাহলে আমি জায়গায় দাঁড়িয়ে মেনে নিলাম। আমি প্রথমদিকেই এমন কিছু চেয়ে নেব যাতে পরে আমাকে আর পরচুলা পরতে না হয়। তাহলে চুক্তি হয়ে যাক! থিবল্ট হাত বাড়িয়ে দিল। নেকড়েটা থাবা উঁচু করেও থেমে গেল।
কী হলো?
ভাবছিলাম, আমার বাবার নখগুলো খুবই ধারালো। তোমার আহত হবার সম্ভাবনা আছে। এরচেয়ে বরং আমরা আরেকটা বিনিময় করি। আমার একটা সোনার আংটি আছে, ওটার সাথে তোমার রূপার আংটি। এতেও অবশ্য তুমিই লাভবান হচ্ছ। থাবা মেলে ধরতেই তাতে নিখুঁত একটা সোনার আংটি দেখতে পেল থিবল্ট। কোনরকম দ্বিধা না করে চুক্তিটা মেনে নিল ও। আংটিবদল করল। দুজন।
তাহলে! এখন আমরা এক হয়ে গেলাম। বলল নেকড়ে।
মানে বলতে চাইছ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। একটু বেশি তাড়াতাড়ি এগোচ্ছ তুমি।
দেখা যাক। এখন তাহলে যে যার কাজে যাই।
বিদায়, মহামান্য নেকড়ে।
আবার দেখা না হওয়া পর্যন্ত, মঁসিয়ে থিবল্ট।
বলার সাথে সাথেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নেকড়েটা। পেছনে রেখে গেল ঝাঁঝালো কটু গন্ধ।
বিস্মিত ভাবে চারপাশে নেকড়েটাকে খুঁজল থিবল্ট। এখনও এমন হুট করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ব্যাপারটার সাথে ঠিক অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি ও।
একবার মনে হলো পুরোটাই স্বপ্ন ছিল কি না। কিন্তু অনামিকার সোনার আংটিটা দেখে বুঝতে পারল ঘটনাটা সত্যি ঘটেছে। আংটিটা খুলে ভাল করে দেখল। আংটিটাতে থ আর শ অক্ষর-দুটো খোদাই করা।
শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল ওর। থিবল্ট আর শয়তান, চুক্তিবদ্ধ দুইজনের নামের আদ্যক্ষর। শয়তানের সাথে চুক্তি করতে গেলে কিছু ছাড় তো দিতেই হবে।
একটা গানের সুর ভঁজার চেষ্টা করল ও। কিন্তু ভয় ওর কণ্ঠ বিকৃত করে দিয়েছে, তাই সে বিরক্ত হয়ে বাদ দিল। নিজের কাজে মন দিল এবার।
শুরু করেও আবার ব্যারনের কুকুর আর শিঙার আওয়াজ শুনে কাজ থামিয়ে দিল থিবল্ট।
ফুলবাবু, যত ইচ্ছা নেকড়ের পিছু ধাওয়া করো। তোমার প্রাসাদে ওর একটা থাবাও নিতে পারবে না। ঘোড়ায় চড়ে বেড়াও বা আর যা-ই করো, একটা অভিশাপেই তোমার চাবুকের শোধ তুলে নিতে পারব আমি। ভাবতে ভাবতেই থেমে গেল ও।
নেব না-ই বা কেনই? ব্যারন আর ম্যাকোটের ওপর শোধ তো নিতেই পারি। একটা চুলেরই তো ব্যাপার। মাথা ভরা সিংহের কেশরের মতো চুলে আঙুল চালাল থিবল্ট।
একটা গেলেও আরও অনেক চুল থাকবে। তাছাড়া শয়তান আমাকে ধোকা দিল কি না, সেটাও প্রমাণ হয়ে যাবে। ঠিক আছে, ব্যারনের কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটুক, আর অপদার্থ ম্যাকোটেরও, আমার সাথে যেমন করেছিল, তেমন খারাপ কিছুই ঘটুক।
অভিশাপ দেয়ার সময় বেশ উদ্বিগ্ন বোধ করছিল ও। শয়তানের ব্যাপার, কিছুই বলা যায় না। আবার কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করল থিবল্ট। অমনোযোগের ফলে হাত কেটে রক্ত বেরোল ওর। দামী একজোড়া জুতোও নষ্ট হলো। তারপর হঠাৎ দূরে জোরালো চেঁচামেচি শুনে কী ব্যাপার দেখার জন্য বাইরে বেরিয়ে এল ও। অদূরে কিছু লোকজনকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। বেশ ধীরে আসছে তারা। কাছে পৌঁছানোর পর বোঝা গেল ওরা ব্যারনের লোক। কিছু একটা বয়ে নিয়ে আসছে। অনেকটা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো। আরও কাছে আসার পর দেখা গেল ওরা ব্যারন আর ম্যাকোটকেই বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। থিবল্টের কপালে ঘাম জমল। কী হয়েছে? জিজ্ঞেস করল ও।
হরিণটাকে দৌড়ে যেতে দেখে ব্যারন ভেবেছিল হাউন্ডগুলোর ডাক শুনে ভয় পেয়ে লুকোবার চেষ্টা করছে ওটা। পরে কুকুরগুলোর আচরণ দেখে বুঝল, ওরা হরিণটাকেই তাড়া করছে। তখন প্রচণ্ড ক্ষেপে যায় ব্যারন। শাপশাপান্ত আর মারামারিতেই ক্ষান্ত হয়নি। ঘোড়া নিয়ে কুকুরের পালে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কুকুরদের এই ভুলের জন্য ম্যাকোটকেই দায়ী করে ব্যারন।
ম্যাকোটও কোন প্রতিবাদ করল না। ও নিজেও কুকুরগুলোর ওপর চড়াও হয়। কুকুরগুলোকে ফেরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে সে।
ওদিকে কুকুরগুলো হরিণটাকে তাড়া করে নদীর দিকে এগোচ্ছিল। ম্যাকোট এগিয়ে গিয়ে ওগুলোকে থামানোর চেষ্টা করল। ঘোড়াটাকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন স্রোতের বেগ খুবই বেশি ছিল। ম্যাকোটের ঘোড়াটা তাল সামলাতে পারল না। প্রথমে ডুবল ঘোড়াটা, তারপর ম্যাকোট নিজে।
ম্যাকোটকে ডুবে যেতে দেখে বিচলিত হয়ে পড়ল লর্ড ভে। নিজের বিশ্বস্ত কর্মচারীদের প্রতি একটা মায়া আছে তার। যে করেই হোক, ম্যাকোটকে উদ্ধার করো। যে ওকে উদ্ধার করতে পারবে তাকে পঁচিশ, না পঞ্চাশ, না একশো লুই পুরস্কার দেব! বলে নিজেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল ব্যারন। কিন্তু দলের অন্যরা তাকে বাধা দিল। আর তাতে করে যে সময়টা নষ্ট হলো, সেটাই নিশ্চিত করল ম্যাকোটের মৃত্যু! শেষবারের মতো যখন ম্যাকোটের মাথা জেগে উঠল পানির উপর, সে তখনও কুকুরগুলোকে ফিরে যেতে বলছিল। সোয়া এক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পরে পাওয়া গেল মৃতদেহটা। এদিকে ম্যাকোট মারা গেছে বোঝার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ব্যারন।