পানির পাত্রটা রেখে একটু কুর্ণিশ করল ও। নেকড়েটাও তৃপ্তির সাথে পানি খেয়ে মেঝেতে লম্বা হলো।
আচ্ছা, এখন শোনো।
আমার কাছ থেকে আরও কিছু চাও? কেঁপে উঠল থিবল্ট।
হ্যাঁ, খুবই জরুরি জিনিস। কুকুরগুলোর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি। ক্রমেই কাছে আসছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এখানে চলে আসবে।
ওদের হাত থেকে আমাকে উদ্ধার করো।
উদ্ধার করব, কীভাবে? আঁতকে উঠল থিবল্ট। এর আগে ব্যারনের শিকারে বাগড়া বাধানোয় কী ফল হয়েছিল খুব ভাল মনে আছে ওর।
ভাবো, একটা কিছু বুদ্ধি বের করো আমাকে বাঁচানোর।
কুকরগুলোর হাত থেকে এখন তোমাকে বাঁচানো মানেই তোমার জীবন বাঁচানো। ওরা যদি একবার তোমার নাগাল পায়, তাহলে তোমাকে টুকরো টুকরো করতে বেশি সময় লাগবে না ওদের। থিবল্ট বুঝতে পারছে, ও এখন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। যদি তোমাকে এখন উদ্ধার করি, বিনিময়ে আমি কী পাব?
বিনিময়ে? কেন, হরিণটা?
তাহলে পানির হিসেবটা?
আমরা বরং নতুন করে আবার আলোচনা শুরু করি। তুমি যদি সমঝোতায় আসতে চাও, আমার আপত্তি নেই। তাড়াতাড়ি বলল, কী চাও আমার কাছে?
তোমাকে এমন বেকায়দায় পেলে অধিকাংশই সম্পদ, ক্ষমতা, সম্মান এসব বাহ্যিক জিনিসই চাইত, কিন্তু আমি তা করব না। গতকাল আমি হরিণটা চেয়েছিলাম, তুমি দিয়েছ। কাল আবার আরেকটা জিনিস চাইতে পারি। আমার এই সমস্যাটা আছে। কখন কী চাই তার ঠিক নেই। সবসময় তো আর তোমার কাছে চাইতে পারব না। শয়তান বা আর যা-ই হও, তোমার কাছে আমার চাওয়া এটাই যে, এখন থেকে আমার সব ইচ্ছা পূরণ হোক।
নেকড়েটার মুখে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গি ফুটে উঠল। এ-ই? তোমার কথার শুরু আর শেষের সুরটা মিলল না।
একজন দরিদ্র মানুষ হিসেবে আমার চাওয়াগুলোও খুব সাধারণ আর ঘোট ছোটই হবে। একটুকরো জমি, ঘর, দুবেলা অন্নসংস্থান, এর বেশি আমার মতো মানুষ আর কী চাইতে পারে।
আমি পারলে খুশি মনে তোমার ইচ্ছা পূরণ করে দিতাম, কিন্তু সেটা সম্ভব
সেক্ষেত্রে কুকুরগুলো তোমার কী হাল করতে পারে সে ব্যাপারে মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করো।
তাহলে তোমার ধারণা যেহেতু সাহায্য চেয়েছি, তুমি যা খুশি তাই চাইতে পারো?
ধারণা না, আমি নিশ্চিত।
তাই! তাহলে তাকাও।
কোনদিকে?
আমি যেখানে ছিলাম। আতঙ্কে পিছিয়ে গেল থিবল্ট। নেকড়েটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কীভাবে, বলার কোন উপায় নেই।
এখনও মনে হচ্ছে তোমার সাহায্য ছাড়া আমি নিরুপায়?
ওহ! শয়তান, তুমি আছ কোথায় এখন?
নাম ধরে ডেকে প্রশ্ন করলে আমাকে উত্তর দিতেই হবে। ঘোত করে জবাব দিল নেকড়েটা। আগের জায়গাতেই আছি।
কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না তো।
কারণ অদৃশ্য হয়ে আছি।
কিন্তু কুকুর, শিকারি, ব্যারন সবাই এখনই চলে আসবে তোমার খোঁজে।
তা আসবে, তবে আমাকে খুঁজে পাবে না।
তোমাকে না পেলে তখন আমার ওপর চড়াও হবে ওরা।
গতকালের মতোই। গতকাল হরিণটাকে ধরার জন্য ছত্রিশ ঘা চাবুকের শাস্তি দিয়েছিল। আজ দেবে বাহাত্তর ঘা। তার উপর আজ আর চুমুর বিনিময়ে বাঁচানোর জন্য অ্যানলেটও আসবে না।
তাহলে এখন কী করব?
হরিণটাকে ছেড়ে দাও। কুকুরগুলো ভুল করে হরিণটাকে ধাওয়া করবে। তোমার বদলে ওরা মার খাবে।
এমন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর, নেকড়ের গন্ধ বলে ভুল করে হরিণকে ধাওয়া করবে, এটা কী সম্ভব?
অদৃশ্য কণ্ঠ উত্তর দিল, সেটা আমার উপর ছেড়ে দাও। এখন তাড়াতাড়ি করো, কুকুরগুলোর আগেই যদি ছাউনিতে পৌঁছাতে না পারো, ব্যাপারটা সুখকর হবে না। আমার জন্য নয় অবশ্য, আমাকে তো ওরা খুঁজে পাবে নাকিন্তু যাকে পাবে, তার জন্য।
থিবল্ট আর অপেক্ষা করল না। একছুটে গিয়ে ছাউনির দরজা খুলে দিল। সাথেসাথেই লাফিয়ে বেরিয়ে এল হরিণটা। নেকড়েটার পায়ের ছাপের উপর দিয়ে ছুটে বনে হারিয়ে গেল। ওদিকে ঘরের একশো গজের মধ্যে চলে এসেছে কুকুরগুলো। পুরো দলটাই দরজা পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। তারপর ডাক ছেড়ে একযোগে হরিণটা যেদিকে গেছে সেদিকে ছুটতে শুরু করল। ভুল গন্ধের পিছনে ছুটছে ওরা। নেকড়েটাকে ছেড়ে হরিণটার পিছু ধাওয়া করেছে।
স্বস্তির একটা শ্বাস ছাড়ল থিবল্ট। তারপর ব্যারনের শিঙার আওয়াজ শুনতে শুনতে ফিরে এল ঘরে। নেকড়েটা সেই আগের জায়গায় শুয়ে আছে। কীভাবে। আবার হাজির হলো কে জানে!
পঞ্চম অধ্যায় – অশুভ চুক্তি
চৌকাঠে জমে গিয়েছিল থিবল্ট। নেকড়েটা এমনভাবে আবার কথা বলতে শুরু করল যেন মাঝখানে কোন বাধা পড়েনি, আমি বলেছি যে তোমার ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। কথাটা পুরোপুরি সত্যি না। আসলে তোমার নিজের সুবিধা এবং আরামের জন্য ইচ্ছাপূরণের ক্ষমতা দেয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।
তারমানে তোমার কাছ থেকে আমি কিছুই আশা করতে পারি না?
ঠিক তা নয়, অন্যদের ক্ষতি চাওয়ার ইচ্ছাপূরণে আমি সাহায্য করতে পারি।
তাতে আমার কী লাভ হবে?
আরে বোকা! কে যেন বলেছিল না, অন্যের দুর্ভাগ্যে-সেটা যদি খুব কাছের বন্ধুরও হয়, তাতেও কিছু না কিছু লাভ থাকেই।
কে বলেছিল, কোন নেকড়ে? নেকড়েরাও যে নিজেদের মধ্যে এমন দর্শন চালাচালি করে তা জানা ছিল না।
না, মানুষই বলেছিল।
পরে কি তার ফাঁসি হয়েছিল?
উল্টো, সে পরে গভর্নর হয়েছিল। ওখানে অবশ্য নেকড়ের সংখ্যাও কম ছিল না। কাছের বন্ধুর দুর্ভাগ্যেও যদি সুখ থেকে থাকে, শক্রর দুর্ভাগ্যে কতটা আনন্দ হবে চিন্তা করো।