থিবল্টের মাথা কাজ করছে না। মনে হচ্ছে চারপাশে ওর ফিসফিস করছে অশুভ আত্মারা।
ওর চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সামনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে নিজেকেই শোনাল, ঈশ্বর বা শয়তান যে-ই দিয়ে থাকুক, হরিণটাকে কাজে না লাগানো বোকামি হয়ে যাবে। অন্ধকারের জগৎ থেকে পাঠানো হলেও, আমি তো আর খেতে বাধ্য নই। তাছাড়া একা এটা খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভবও না। অন্য কাউকে সাথে নিতে হলেও তো ঠকা হয়ে গেল। তার চেয়ে মঠের নানদের কাছে বিক্রি করে দিলে ভাল দাম পাব। আর অন্ধকারের ছোঁয়া থাকলেও, ওখানকার পবিত্র পরিবেশে তা দূর হয়ে যাবে, আমিও বেঁচে যাব। হরিণটাকে বিক্রি করে যা পাব, সারাদিন খাটনি করে তার এক-চতুর্থাংশও পাই না। মুখ ঘুরিয়ে থাকা ঈশ্বরের চেয়ে সাহায্যকারী শয়তান অনেক ভাল। শয়তান আমাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু আমিও তো বোকা নই। আমার যা খুশি, তাই করতে পারি।
অনেক যুক্তি বের করে ফেলল থিবল্ট। অথচ মিনিট পাঁচেক আগেও কপাল পর্যন্ত হাত তুলতে পারছিল না। হরিণটা রেখেই দেবে ও। সুযোগমতো বিক্রি করে দেবে। এমনকি এ-ও চিন্তা করল-ওই টাকায় ওর হবু বৌয়ের জন্য বিয়ের কাপড় কিনবে। অ্যানলেটের মতো এক দেবদূত বাড়িতে থাকলে, কোন শয়তানই বাড়ির চৌকাঠ পেরোনোর সাহস পাবে না।
শয়তান যদি বাড়াবাড়ি শুরু করে দেয়, আমি অ্যানলেটের দাদীর কাছে গিয়ে ওকে চাইব। শয়তানের ধোকায় প্রার্থনা ভুলে গেলেও কোন সমস্যা নেই, লক্ষ্মীমন্ত একটা বউ থাকবে, যার সাথে শয়তানের কোন দেনা পাওনা থাকবে না, সে-ই আমার হয়ে প্রার্থনা করবে।
এভাবে নিজেকে আশ্বস্ত করে হরিণটাকে খাবার দিয়ে এল থিবল্ট। ওটার ঘুমানোর জায়গাটা আরামদায়ক আছে কি না তাও দেখল। ভাল দাম পেতে হলে একটু যত্ন-আত্তি তো করতে হবে।
ওদিকে পরদিন সকালে আবার শিকারে বেরোল ব্যারন। তবে এবার কোন দুর্বল হরিণ নয়-আগেরদিন যার পিছু নিয়েছিল ম্যাকোট, সেই নেকড়েটাই ওদের লক্ষ্য।
নেকড়েটা যে আসলেই ঘাগু নেকড়ে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বহুবছরের অভিজ্ঞতা ওর সম্বল এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। গায়ের রঙ পুরোটাই কালো। অনেক ঘোরাল ওটা শিকারি-দলকে। পিছু ধাওয়া করে আগেরদিনের এলাকায় চলে এল ব্যারন। এগিয়ে চলল জুতো-কারিগরের কুঁড়ের দিকে।
সন্ধ্যায় অ্যানলেটের সাথে দেখা করতে যাবে, তাই সকাল সকাল কাজ শুরু করেছে থিবল্ট। দিনের বেলা হরিণটাকে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়াটা বোকামি হবে। বনরক্ষকের সামনে পড়লে কোন সদুত্তর দিতে পারবে না। কোন এক সন্ধ্যায় বেরিয়ে চুপি চুপি কনভেন্টে চলে যাবে।
শিঙার আওয়াজ শোনার সাথে সাথেই ছাউনির দরজার সামনে একগাদা লতাপাতা এনে স্তূপ করল। যাতে দরজাটা কারও চোখে না পড়ে। তারপর এসে এত গভীর মনোযোগে কাজ শুরু করল, যেন চোখ পর্যন্ত তোলার ফুরসত নেই। ওর।
হঠাৎ দরজায় খামচাননার শব্দ পেয়ে উঠে দাঁড়াল ও। কিন্তু যাওয়ার আগেই দরজা খুলে গেল। থিবকে বাকরুদ্ধ করে দিয়ে পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে একটা কালো নেকড়ে এসে ঢুকল ভেতরে! তবে ঘরের মাঝখানে এসে নেকড়েদের মতো করেই বসে পড়ল ওটা। জুলজুল করে তাকাল জুতোর কারিগরের দিকে।
নেকড়েটাকে তাড়ানোর জন্য একটা কুঠার মাথার ওপর তুলে নিল থিবল্ট।
হেসে উঠল নেকড়েটা! কেমন একটা কৌতুকের আভাস খেলে গেল ওটার মুখে। থিবল্ট এর আগে কখনও কোন নেকড়েকে হাসতে শোনেনি। কুকুরের মতো ডাকতে শুনেছে, কিন্তু ওরা মানুষের মতো হাসে তা জানত না। আর সে কী হাসি! কোন মানুষও যদি এভাবে হাসত, তবুও পিলে চমকে যেত থিবল্টের। কুঠার ধরা হাতটা নামিয়ে নিল ও।
তুমি একটা মানুষ বটে! ওর বিস্ময়কে আরও বাড়িয়ে দিয়ে ভরাট এবং গম্ভীর গলায় বলে উঠল নেকড়েটা। তোমার অনুরোধ রাখতে রাজার বন থেকে সবচেয়ে চমৎকার হরিণটাকে পাঠালাম। আর তুমি কিনা আমারই মাথা দুভাগ করে দিতে চাইছ! মানুষের কৃতজ্ঞতাবোধ দেখি নেকড়েদের মতোই! একটা পশুর গলা দিয়ে ওর মত কথা বেরোচ্ছে দেখে হাঁটু কাঁপতে শুরু করল থিবল্টের। হাত থেকে খসে?
নেকড়েটা আবার বলতে লাগল, এসো, অবুঝ না হয়ে বন্ধুর মতো বসে কথা বলি। গতকাল তুমি ব্যারনের হরিণটা চেয়েছিলে। আমি ওটাকে ধরে তোমার ছাউনিতে নিয়ে এলাম। যাতে পালিয়ে যেতে না পারে তাই দড়ি দিয়ে বেঁধেও রাখলাম। তার বিনিময়ে তুমি আমাকে কুঠার দেখাচ্ছ?
আমি কীভাবে জানব তুমি কে?
আচ্ছা, আমাকে চিনতে পারোনি! ভাল কারণ বের করেছ।
আমার কোন বন্ধুর কি এমন বিদঘুঁটে কোট পরে আসার কথা?
বিদঘুঁটে কোট? তা বটে! রক্তের মতো লাল জিভ বের করে নিজের পশম চেটে দিল নেকড়ে। আচ্ছা লোক বটে তুমি! তোমাকে খুশি করা তত বেশ কঠিন দেখা যাচ্ছে। যা-ই হোক, আমি তোমার কাজটা যে করে দিলাম, তার বিনিময়ে কিছু দিতে রাজি আছ তো?
অবশ্যই, বললেও, অস্বস্তিবোধটা এড়াতে পারল না। তবে আগে জানা দরকার তুমি কী চাও? বলো! কী চাও?
প্রথমেই এক গ্লাস পানি। কুকুরগুলোর ধাওয়া খেয়ে আমার দম শেষ।
এখনই দিচ্ছি।
ঘরের কাছেই একটা পানির উৎস আছে। সেখান থেকে পরিষ্কার পানি এনে দিল থিবল্ট। এবং এত অল্পে পার পেয়ে যাওয়ার স্বস্তিটা ও লুকাতে পারল না।