হ্যাঁ, যদি তাতে আমার দাদীমার ভাল হয়।
থিবল্ট অ্যানলেটের হাত ধরল।
ঠিক আছে অ্যানলেট, খুব শীঘ্রই আমরা আবার কথা বলব।
যখন তুমি চাও, থিবল্ট।
অ্যানলেট, আমি যদি তোমাকে বিয়ে করি, তুমি কথা দিচ্ছ তুমি আমাকে ভালবাসবে?
স্বামী ছাড়া অন্য কাউকে কি আমার ভালবাসার কথা?
শুধু একটা প্রতিজ্ঞা করো। বল, মঁসিয়ে থিবল্ট, তোমাকে ছাড়া আর কাউকে আমি ভালবাসব না।
প্রতিজ্ঞার কী দরকার? একজন সৎ লোকের জন্য এক সত্যবাদী মেয়ের মুখের কথাই কি যথেষ্ট নয়?
আমরা কবে বিয়ে করব, অ্যানলেট? বলতে বলতে অ্যানলেটের কোমরে . হাত রাখল থিবল্ট।
নিজেকে ছাড়িয়ে নিল অ্যানলেট।
দাদীমার সাথে দেখা করো। তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। এখন আমাকে বোক নিয়ে বাড়ি যেতে সাহায্য করো। অনেক দেরি হয়ে গেছে।
অ্যানলেটকে গ্রামের কাছে পৌঁছে দিল থিবল্ট। বিদায় নেয়ার আগে অনেক অনুরোধ উপরোধ করে একটা চুমু আদায় করল ও। ব্যারনকে চুমু খাওয়ার সময় কোন অস্বস্তিবোধ হয়নি। কিন্তু এই চুমুতে লজ্জাবোধ করল অ্যানলেট। মাথার ভারি বোঝাটা নিয়ে দ্রুত বাড়ির দিকে চলে গেল ও। নীল আকাশের পটভূমিতে ছায়ার মতো অপস্রিয়মাণ মেয়েটাকে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল থিবল্ট। অ্যানলেট দৃষ্টির আড়ালে যাওয়ার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করল। এই চমৎকার তরুণীটি ওর হবে, এটা ওর চিন্তার কারণ নয়। অন্যের জিনিস পাওয়ার একটা দুর্ভাগ্যজনক আকাঙ্ক্ষা ওর ভেতর আছে। অ্যানলেট সুন্দরী এক তরুণী। অন্য কেউ আগেই যাতে অ্যানলেটকে পেতে না পারে, তাই ও অ্যানলেটকে চেয়েছে। যে সরলতা নিয়ে অ্যানলেট ওর সাথে কথা বলেছে, তাতে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা আরও ত্বরান্বিত হয়েছে। তবে এটা ক্ষণিকের আবেগ, গভীর কোন অনুভূতি নয়। এখানে হৃদয়ের চেয়ে হিসেবের জায়গা বেশি। থিবল্টের পক্ষে প্রেমিকের মতো ভালবাসা সম্ভব নয়। নিজে দরিদ্র হয়েও আরেকটা দরিদ্র মেয়েকে ভালবাসা পাওয়ার জন্য ভালবাসার চিন্তা করা ওর পক্ষে অসম্ভব। তাই অ্যানলেট যত দূরে সরে যেতে লাগল, ততই নিজের ঈর্ষাকাতর উচ্চাকাঙ্ক্ষা থিবকে অধিকার করতে লাগল। ও যখন বাড়ি পৌঁছল, ততক্ষণে পুরো অন্ধকার নেমে গেছে।
চতুর্থ অধ্যায় – কালো নেকড়ে
সারা দিনের ধকলে প্রচণ্ড ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত থিবল্ট। হরিণটাও মারতে পারেনি। তাই খাওয়াটা প্রত্যাশা অনুযায়ী হলো না ওর। কিন্তু ভয়ংকর ক্ষুধার কারণে শুকনো রুটির স্বাদও হরিণের মাংসের চেয়ে খারাপ লাগল না।
হঠাৎ করেই ওর পোষা ছাগলটা ডাকতে শুরু করল। ওটারও মনে হয় খিদে পেয়েছে। এক বোঝা ঘাস নিয়ে ছাউনির দরজা খুলল থিবল্ট। দরজা খোলার সাথে সাথে ছাগলটা ওকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে বাড়ির দিকে দৌড় দিল। ঘাসের বোঝা ফেলে ওটাকে ধরতে গেল থিবল্ট। শিং ধরে অনেকক্ষণ যুদ্ধ করার পর অবশেষে আবার ছাগলটাকে ছাউনিতে নিতে পারল ও। তারপর ফিরল খাওয়া শেষ করতে। কিন্তু ঘাস খাবার বদলে করুণ স্বরে চিৎকার জুড়ে দিল ছাগলটা। অগত্যা আবার খাওয়া বন্ধ করে উঠে পড়তে হলো থিবল্টকে। সাবধানে দরজা খুলে ছাউনিতে ঢুকে অন্ধকার কোনাগুলো হাতড়ে দেখতে লাগল ও। যথেষ্ট সাহসী থিবল্ট। কিন্তু ঈষদুষ্ণ, মোটা চামড়ার ভিন্ন একটা প্রাণীর স্পর্শ পাওয়া মাত্র চমকে উঠে হাত টেনে নিল ও। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বাতি এনে আলো ফেলল ছাউনিতে। ছাগলটা যে প্রাণীটাকে দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করছিল, সেটাকে চিনতে পেরে ওর হাত থেকে বাতিটা পড়ে যাবার উপক্রম হলো। সেই হরিণটা, যার পিছনে ব্যারন আর তার হাউন্ডগুলো সারাদিন ঘুরেছে। যেটাকে ঈশ্বরের নামে মারতে না পেরে থিবল্ট এমনকি শয়তানের কাছে পর্যন্ত আর্জি জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ওকে চাবুকের বাড়িও খেতে হয়েছে এটারই কারণে। দরজাটা বন্ধ আছে কি না ভাল করে দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল ও। তারপর হরিণটার দিকে এগিয়ে গেল। হয় খুব ক্লান্ত, নয়তো প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে ওটা। ওকে এগোতে দেখেও কিছুই করল না। শুধু কালো বড় মসৃণ চোখজোড়া তুলে তাকিয়ে রইল।
নিজেকেই বলল থিবল্ট, নিশ্চয়ই দরজা খোলা রেখে গিয়েছিলাম। কোথায় লুকাবে বুঝতে না পেরে হরিণটা শেষমেশ এখানে এসে ঢুকেছে। কিন্তু তারপরই মনে পড়ল ওর, হুড়কোটা এত শক্ত ভাবে এটে গিয়েছিল যে একটু আগেই হাতুড়ি এনে খুলতে হয়েছে ওটা। তাছাড়া দরজা খোলা থাকলে তো ছাগলটা আরও আগেই বেরিয়ে যেত। আরেকটু ভাল করে খেয়াল করে দেখল, হরিণটা দড়ি দিয়ে বাঁধা।
ভীতু নয় থিবল্ট, কিন্তু এখন ওর কপালে ঘাম জমতে শুরু করল। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল। ছাউনি থেকে বের হয়ে দরজা আটকে দিল ও। ছাগলটা এই সুযোগে আবার বেরিয়ে গেছে। ঘরে ঢুকে আগুনের পাশে বসে পড়েছে। ওখান থেকে নড়ার বিন্দুমাত্র কোন লক্ষণ নেই ওটার।
ও শয়তানের কাছে আর্জি জানিয়েছিল সত্যি, কিন্তু এভাবে সেটা সত্যি হয়ে যাবে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে থিবল্টের। অন্ধকারের শক্তির ছত্রছায়ায় থাকার ব্যাপারটা ওর মনে ভয় ধরিয়ে দিল। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে গিয়ে বাণী মনে করতে পারল না। বুকের কাছে ক্রুশ আঁকতে চেষ্টা করল, কিন্তু হাত উঠল না।