এভাবে বলছ কেন? কাছে এসে বলল অ্যানলেট, ব্যারন খুবই দয়ালু লোক। গরিবদের প্রতি অনেক অনুগ্রহ করেন। মেয়েদের সঙ্গেও খুবই ভদ্র ব্যবহার করেন তিনি।
তা তো বটেই, যে মারগুলো আমাকে মেরেছে, তার প্রতিটার জবাব কী দেই দেখো।
এটা তো স্বীকার করবে যে মার খাবার মতো কাজ তুমি করেছ।
আচ্ছা! ব্যারনের চুমু খেয়ে সুন্দরী অ্যানলেটের মাথা ঘুরে গেছে নাকি?
মঁসিয়ে বিবল্ট, অন্তত তোমার কাছ থেকে এই চুমু নিয়ে কোন কথা আমি। আশা করিনি। তারপরও বলব, ব্যারন তার অধিকারের মধ্যে থেকেই কাজটা করেছেন।
আমাকে এভাবে মেরে!
তুমি কেন লর্ডদের এলাকায় শিকার করতে গেছ?
কৃষক কি ধনী, শিকারের অধিকার সবার আছে।
অবশ্যই না। জম্ভগুলো ঘুরে বেড়ায় ওদের এলাকায়, ওখানকার ঘাস খায়। অরলিয়ন্সের ডিউকের এলাকার হরিণকে লক্ষ্য করে বর্শা ছোঁড়ার অধিকার তোমার নেই।
তোমাকে কে বলেছে আমি বর্শা ছুঁড়েছি? আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে অ্যানলেটের দিকে একটু এগোল থিবল্ট।
কে বলবে? আমি নিজের চোখে দেখেছি। আমাকে মিথ্যে বলল না। গাছের আড়াল থেকে তুমি যখন বর্শাটা ছুঁড়লে, তখনই দেখেছি আমি তোমাকে।
মেয়েটার সরল সত্যবাদিতার সামনে মিথ্যেটা ধরা পড়ে যাওয়ায় থিবল্টের রাগ মিইয়ে গেল।
যা-ই হোক, গরীবদেরও কখনও না কখনও লর্ডদের মতো ভালমন্দ খেতে ইচ্ছা করতেই পারে। মাদমোয়াজেল অ্যানলেট, তুমি হলে কী করতে, খরগোশ মারার জন্য কাউকে ফাঁসিতে ঝোলাতে? আর তাছাড়া, ঈশ্বর কি শুধু ব্যারনদের জন্যই হরিণ সৃষ্টি করেছেন?
মঁসিয়ে থিবল্ট, ঈশ্বর অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ না করতে বলেছেন। ঈশ্বরের আইন মেনে চলল, ভাল থাকবে।
তুমি আমাকে আমার নাম ধরে ডাকছ, তারমানে কি আমাকে চেনো?
হ্যাঁ, চিনি। উৎসবের দিন বুসোনে তোমাকে দেখেছি। ওরা তোমাকে সুন্দর নাচিয়ে বলছিল। যারা চারপাশে দাঁড়িয়ে নাচ দেখছিল, আমি তাদের মধ্যে ছিলাম।
প্রশংসা শুনে থিবল্ট একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে গেল।
আচ্ছা, আচ্ছা, তোমাকে দেখেছি মনে হচ্ছে। একসাথে বোধহয় আমরা নেচেওছিলাম। তখন এত লম্বা ছিলে না, তাই চিনতে পারিনি। কিন্তু এখন একটু একটু মনে পড়ছে। তুমি গোলাপি আর সাদা রঙের জামা পরেছিলে। আমরা একটা খামারে নেচেছিলাম। আমি তোমাকে চুমু খেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি রাজি হওনি।
তোমার স্মৃতিশক্তি বেশ ভাল, মঁসিয়ে থিবল্ট।
তোমাকে দেখেছিলাম তা প্রায় একবছর হবে। কী জানো অ্যানলেট, এই একবছরে তুমি শুধু লম্বাই হওনি, অনেক সুন্দরও হয়েছ। একসাথে এই দুটো কাজ যে সাফল্যের সাথে করতে পারো, এটা স্বীকার করতেই হবে।
লজ্জায় লাল হয়ে গেল মেয়েটার গাল। চোখ নামিয়ে নিল ও। লজ্জা পাওয়ায় ওকে আরও আকর্ষণীয় লাগছে।
থিবল্ট আরও ভাল করে অ্যানলেটকে লক্ষ করতে লাগল। পরের প্রশ্নটা করার সময় ওর গলায় উদ্বেগ প্রকাশ পেল।
তোমার প্রেমিক আছে, অ্যানলেট?
না, কখনও ছিল না। আর আশা করি হবেও না।
কেন? প্রেমের দেবতা কি এতই খারাপ যে তুমি তাকে ভয় পাও?
তা নয়, আমি আসলে প্রেমিক চাই না।
কী চাও তাহলে?
স্বামী।
থিবরে নড়ে ওঠাটা অ্যানলেট হয় দেখেনি, আর নয়তো দেখেও না দেখার ভান করল।
ও আবারও বলল, দাদীমা অসুস্থ। তার দেখাশোনা আমাকেই করতে হয়। প্রেমিক থাকলে দাদীমার দেখাশোনা ঠিক মতো করতে পারব না। কিন্তু ভাল একজন স্বামী হলে, সে আমাকে দাদীমার দেখাশোনা ছাড়াও অন্যান্য কাজে সাহায্য করতে পারবে।
কিন্তু স্বামী কি চাইবে, তুমি দাদীকে তার চেয়ে বেশি ভালবাসো? যদি ঈর্ষাবোধ করে?
মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে অ্যানলেট উত্তর দিল, সেটা নিয়ে কোন ভয় নেই। আমি আমার স্বামীকেও এতটা ভালবাসব যাতে সে অভিযোগ করার কোন সুযোগ না পায়। সে যত ধৈর্য আর নম্রতা দেখাবে দাদীমার প্রতি, আমি তত তার প্রতি মনোযোগ দেব। আরও পরিশ্রম করব যাতে সংসারে কোন কিছুর কমতি না থাকে। আমাকে দেখে ছোটখাটো মনে হতে পারে, কিন্তু পরিশ্রম করার মানসিকতা আমার আছে। মনের জোর থাকলে দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করা যায়। আমি, আমার স্বামী এবং দাদীমা, আমরা ঠিক সুখী হব।
বলতে চাইছ, তিনজন একসাথে খুব গরীব থাকবে।
তোমার কি ধারণা গরীবদের ভালবাসা ধনীদের চাইতে একটা মুদ্রাও কম? যখন দাদীমা আমাকে দুর্বল হাতে জড়িয়ে ধরে, বয়স্ক, কোঁচকানো মুখটা আমার মুখের সাথে চেপে ধরে, তার ভালবাসার অশ্রুতে আমার গাল ভিজে যায়, আমিও কাঁদতে শুরু করি, মঁসিয়ে থিবল্ট। আমাদের দুজনের মতো অভাবী হয়তো এ দেশে আর কেউ নেই। কিন্তু আমার বিশ্বাস ওই মুহূর্তে আমি যতটা সুখ অনুভব করি, রাণী বা রাজকুমারীরা তাদের সর্বোচ্চ সুখের দিনেও ততটা সুখ অনুভব করে না।
মেয়েটার কথা শুনতে শুনতে নানান কথা ভাবছিল থিবল্ট; যে কিনা লর্ড, ডিউক এদের দুর্গ-প্রাসাদে কত উৎসব অনুষ্ঠান হতে দেখেছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছে অভিজাত কোন নারীকে সঙ্গী হিসেবে পাবার। সে-ই এখন ভাবছে, অ্যানলেট নামের এই সুন্দর, নম্র স্বভাবের মেয়েটিকে যদি নিজের করে পায়, তাহলে ব্যারনদেরও ঈর্ষার পাত্র হতে পারবে ও।
আচ্ছা, অ্যানলেট। যদি আমার মত কেউ তোমার স্বামী হতে চায়, তুমি তাকে গ্রহণ করবে?
সবাই বলে থিব সুদর্শন। তাছাড়া সারা ফ্রান্স ভ্রমণের সুবাদে নিজ কাজে দক্ষতা ছাড়াও আরও অনেক কিছুই জানে ও। তার ওপর বিশেষ কোন ঘটনা না ঘটলে, একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েই যায়। অ্যানলেট থিবল্টের জীবন বাঁচানোয় এক্ষেত্রে যেমন হয়েছে। ম্যাকোট যেভাবে মারছিল, তাতে ছত্রিশ ঘা খেলে থিবলের আর বাঁচার আশা ছিল না।