ঠিক এই সময় একটা মেয়ে ছুটে বেরিয়ে এল বনের ভেতর থেকে। ঘোড়ার পাশে অশ্রুভেজা সুন্দর চোখজোড়া তুলে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। ব্যারনকে অনুনয়ের সুরে বলল, ঈশ্বরের দোহাই মাই লর্ড, মানুষটাকে দয়া করুন।
নিচের দিকে তাকাল ব্যারন। বেশি হলে ষোলো বছর হবে ওর বয়স। চমৎকার হালকা-পাতলা শরীর। দুধে আলতা গায়ের রঙ। বড় বড় নীল চোখ। মাথা ভর্তি ঢেউ খেলানো চুল কাঁধ ছাড়িয়েছে। কমনীয় মুখভঙ্গিতে মেয়েটাকে যথেষ্ট আকর্ষণীয় লাগছে।
এতসব কিছু লক্ষ করতে ব্যারনের মাত্র একটা মুহূর্ত লাগল। সাধারণ অনাড়ম্বর পোষাকে ঢাকা থাকলেও সুন্দরকে চিনে নিতে অসুবিধা হয়নি তার। কোন জবাব না দিয়ে মেয়েটার আকুল চোখের দিকে তাকিয়ে রইল ব্যারন।
চাবুকের বাড়ি বন্ধ হচ্ছে না দেখে আবার কেঁদে উঠল মেয়েটা।
মাই লর্ড, ঈশ্বরের দোহাই, দয়া করুন! আপনার লোকদের থামতে বলুন। মানুষটার চিৎকার আর সহ্য করতে পারছি না।
বিরক্তি প্রকাশ করে লর্ড ভেস বলল, এই বদমাশটার জন্য কাঁদছ? কে হয় ও তোমার, ভাই?
না, মাই লর্ড।
তোমার কাজিন? না, মাই লর্ড।
তোমার প্রেমিক?
প্রেমিক! মাই লর্ড, মজা করছেন আমাকে নিয়ে।
কেন, হতে পারে না? সত্যি হলে স্বীকার করছি, মেয়ে, ওকে আমার অনেক হিংসা হবে।
চোখ নিচু করল মেয়েটা।
ওকে আমি চিনি না, মাই লর্ড আজকের আগে কখনও দেখিনি।
এনগুভা একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারল না। উল্টো দিক থেকে দেখছে তাই বোধহয় চিনতে পারছে না।
চুপ! কড়া সুরে বলল ব্যারন। তারপর আবার হাসিমুখে মেয়েটার দিকে ফিরল।
আচ্ছা! তাহলে স্বজন নয়, বন্ধু নয়, এমন কারো জন্য কতদূর ত্যাগ স্বীকার করতে রাজি আছ, দেখা যাক।
কীভাবে মাই লর্ড?
ওই বদমাশটার জন্য দয়ার বিনিময়ে একটা চুমু চাই!
একটা চুমুর বিনিময়ে একটা মানুষের জীবন বাঁচবে। আমি নিশ্চিত এতে কেউ কোন পাপ ধরবে না।
ব্যারনের অনুমতির অপেক্ষা না করে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। কাঠের জুতো জোড়া খুলে ফেলল। নেকড়ে শিকারির বুটের ওপর পা রেখে ঘোড়ার কেশর ধরে নিজেকে উঁচু করল ও। পরিষ্কার, নরম চিবুকটা এগিয়ে দিল ব্যারনের দিকে।
একটা চুমুর কথা থাকলেও ব্যারন দুটো চুমু খেল। তবে কথা রাখল সে। ম্যাকোটকে ইঙ্গিত করল শাস্তি বন্ধ করতে।
ম্যাকোট ওদিকে নিষ্ঠার সাথে গুণে গুণে চাবুকের বাড়ি মারছিল। বাবো নম্বরটা যখন নামতে শুরু করেছে, তখন মার বন্ধ করার আদেশ পেল সে। চাবুকের এই শেষ বাড়িটা না থামিয়ে দ্বিগুণ জোরে চালাল-যেন বারোর সঙ্গে তেরো নম্বরটাও মিশিয়ে দিতে চাইছে! এটার দাগ থিবল্টের কাঁধে আগেরগুলোর চাইতেও গভীরভাবে বসে গেল। তবে তার পরপরই খুলে দেয়া হলো ওর বাঁধন।
ব্যারন তখন মেয়েটার সাথে কথা বলছে।
নাম কী তোমার?
জর্জিনা অ্যানলেট, আমার মায়ের নামে নাম। অবশ্য গাঁয়ের লোক আমাকে শুধু অ্যানলেট বলেই ডাকে।
নামটা শুভ নয়।
কোন্ দিক থেকে, মাই লর্ড?
যে কোন সময় নেকড়ের শিকার হয়ে যেতে পারো! তুমি থাকো কোথায়, অ্যানলেট?
পোসিয়ামন-এ, মাই লর্ড।
ওখান থেকে একা একা এই বনে চলে এসেছ? তোমার সাহস আছে।
বাধ্য হয়েই আসতে হয়, মাই লর্ড। আমার আর দাদীমায়ের তিনটা ছাগল পালতে হয়।
আচ্ছা, ছাগলের ঘাস নিতে আসো?
জি, মাই লর্ড।
একে তোমার বয়স কম, তায় সুন্দরী আবার সাহসীও?
মাঝে মাঝে ভয়ে কেঁপে উঠি মাই লর্ড।
কীসের ভয়ে?
শীতের সন্ধ্যায় নেকড়ে-মানবদের অনেক গল্প শুনেছি, মাই লর্ড। যখন একা থাকি, বাতাসের ধাক্কায় গাছের শাখা থেকে শব্দ ওঠে, তখন আমার শরীরে ভয়ের শিহরণ বয়ে যায়, গায়ের নোম দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু যখন শিকারি কুকুরগুলোর চিৎকার আর আপনার শিঙার শব্দ ভেসে আসে, তখন আবার নিজেকে নিরাপদ মনে হয়।
মেয়েটার জবাবে খুশি হয়ে দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে ব্যারন বলল, তা বটে, নেকড়েদের আমরা দৌড়ের ওপর রাখি। তবে মেয়ে, একটা রাস্তা আছে তোমার এই ভয় থেকে মুক্তি পাওয়ার।
কীভাবে, মাই লর্ড?
ভেযের দুর্গ-প্রাসাদে চলে এসো। নেকড়ে-মানব তো দূরের কথা, কোন ধরনের কোন হিংস্র পশুই ওর সীমানায় ঢুকতে পারে না। অন্তত জীবিত অবস্থায় তো নয়ই।
অ্যানলেট না সূচক ভাবে মাথা নাড়ল।
কেন, আসবে না কেন?
নেকড়ের চাইতেও খারাপ কিছু থাকতে পারে ওখানে।
শুনে হাসতে শুরু করল ভেযের লর্ড। মনিবকে হাসতে দেখে দলের অন্যরাও অনুকরণ করল। আনলেটের দর্শনে আবার খোশমেজাজে ফিরে গেছে ব্যারন। আরও অনেকক্ষণ হেসেই যেত সে, কিন্তু মাঝখান থেকে বাগড়া দিল ম্যাকোট। কুকুরগুলোকে জড়ো করে এনে মনে করিয়ে দিল, দুর্গে ফিরতে হলে এখনও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে সবাইকে। ব্যারন উৎফুল্ল মনে মেয়েটার দিকে আঙুল নাচিয়ে দলের সাথে ফিরতি পথ ধরল।
থিবল্টের সাথে একা হয়ে গেল অ্যানলেট। সুন্দরী ও, তাছাড়া থিবল্টের জীবনও বাঁচিয়েছে। এমন মিষ্টি একটা মেয়ের সাথে নিজেকে একা আবিষ্কার করার পরও, থিবল্টের চিন্তা জুড়ে তখনও শুধুই প্রতিশোধ আর ঘৃণা। সকাল থেকেই অন্ধকারের পথে একটু একটু করে পা বাড়াচ্ছে ও। শয়তান যদি আমার আর্জিটা এই বেলা শুনত, অপস্রিয়মাণ শিকারি দলের দিকে হাত নেড়ে বলল ও। যদি শুধু একবার শুনত, আমাকে যে পরিমাণ কষ্ট দিয়েছ, তার উচিত জবাব তোমরা পেতে