থিবল্ট ওক গাছের মগডালে বসে ছিল। সেদিকেই নির্দেশ করল এনগুভা।
কপালে হাত দিয়ে সরাসরি সূর্যের আলো আড়াল করে উপরে গাছের দিকে তাকাল ব্যারন-এবং দেখতে পেল থিবন্টকে।
এনগুভা বলল, মাই লর্ড, যদি চান তো আমি গিয়ে… বলে গাছে চড়ার ইঙ্গিত করল সে।
হাত তুলে নিষেধ করল ব্যারন।
এই যে, উপরে যে আছ, থিবকে তখনও চিনতে পারেনি ব্যারন, আমার একটা কথা জানার ছিল। জবাব দেবে?
উত্তরের অপেক্ষায় একটুক্ষণ চুপ করে থাকল ব্যারন।
তাহলে জবাব দেবে না! তুমি বোধহয় কানে কম শোনো। অসুবিধা নেই, কথা বলানোর ট্রাম্পেট আছে আমার, বলে ম্যাকোটের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে আর ম্যাকোট সেই হাতে ধরিয়ে দিল বন্দুক।
এদিকে থিবল্ট একমনে গাছের ডাল কাটার ভান করতে লাগল। ব্যারন কী করছে সেটা যেন ও দেখেইনি। বা দেখলেও গুরুত্ব দেয়নি।
উত্তরের জন্য একটু অপেক্ষা করে গুলি ছুঁড়ে দিল ব্যারন। করাৎ করে আওয়াজ হলো ডাল ভাঙ্গার।
ব্যারনের নিশানা খুবই ভাল। থিবল্টের ডালের গোড়াতেই গিয়ে লেগেছে গুলিটা। আশেপাশে আরও ডাল থাকলেও পতন ঠেকাতে পারল না ও। তবে গাছটায় ডালপালা অনেক আর খুব ঘন। তাই পতনটা থেমে থেমে হলো। অবশেষে ও মাটিতে এসে পড়ল।
আরে! নিজের নিশানার সাফল্যে নিজেই মুগ্ধ ব্যারন। এ তো সকালের সেই জোকারটা। তো, আমার চাবুকের সাথে কাটানো সময়টা খুব কম মনে হয়েছিল তোর, তাই না? আবার চলে এসেছিস দেখা করতে?
নিখাদ আন্তরিকতার সুরে থিবল্ট বলল, একদমই না, মাই লর্ড।
তাহলে সেটা তোর চামড়ার জন্যই ভাল, এখানে গাছের মগডালে বসে কী করছিস?
মাই লর্ড নিজেই দেখতে পাচ্ছেন, আশপাশে ছড়ানো ছিটানো শুকনো কাঠের দিকে নির্দেশ করল থিবল্ট। জ্বালানীর জন্য কাঠ সংগ্রহ করছিলাম।
এবার আর ফালতু কথা না বলে সরাসরি বল, হরিণটার কী হয়েছে?
শয়তানের দিব্যি, ও যেখানে বসেছিল, ওখান থেকে সব পরিষ্কার দেখা যাওয়ার কথা, ম্যাকোট যোগ করল।
বিশ্বাস করুন, মাই লর্ড। হরিণটার ব্যাপারে আপনি কী জানতে চাইছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
আমিও সেরকমই ধারণা করেছিলাম, ব্যঙ্গের সুরে বলল ম্যাকোট। ও হরিণটাকে দেখেনি। হরিণটার ব্যাপারে কী জানতে চাইছি তা-ও বুঝতে পারছে না। কুকুরগুলো যেখানে থেমে গেছে, ওখান পর্যন্ত হরিণটার চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। অথচ মাটির ওপর যেখানে আরও চিহ্ন থাকার কথা, সেখানে কোন দাগই নেই।
শুনেছিস? ব্যারনও যোগ করল। তুই উপরে ছিলি আর হরিণটা নিচে। ইঁদুরের মতো নিঃশব্দে চলাফেরা নিশ্চয়ই করেনি। আর তুই বলছিস বটে যে কিছু দেখিসনি তুই, শুনিসওনি। কিন্তু আমি বলছি তুই অবশ্যই দেখেছিস, নয়তো শুনেছিস!
ম্যাকোট বলল, এটা পরিষ্কার যে ও হরিণটাকে মেরে কোন একটা ঝোপে লুকিয়ে রেখেছে।
মাই লর্ড, থিবল্ট খুব ভাল করেই জানে ম্যাকোটের ধারণা কতটা ভুল। স্বর্গের সব সাধু-সন্তদের দিব্যি দিয়ে বলছি, আমি হরিণটাকে মারিনি। আমি যদি হরিণটার গায়ে একটা আঁচড়ও কেটে থাকি, তাহলে জায়গায় দাঁড়িয়ে বলছি, আমার আত্মা কোনদিন মুক্তি পাবে না। তাছাড়া আঘাত না করে কীভাবে হরিণটাকে মারতাম। আর আঘাত করলে তো রক্তের দাগ থাকত। খুঁজে দেখুন, মাই লর্ড। ম্যাকোটের দিকে তাকিয়ে বলল, ঈশ্বর জানেন, কোথাও কোন রক্তের দাগ আপনি পাবেন না। তাছাড়া নিরীহ জটাকে আমি মারব কী দিয়ে? অস্ত্র কোথায় আমার? আপনিই দেখুন মাই লর্ড, এই কাটারিটা ছাড়া আর কোন অস্ত্র নেই আমার কাছে।
কিন্তু থিবল্টের কপাল খারাপ। এনভা আশেপাশের ঝোঁপঝাড়ে চুঁ মেরে বেড়াচ্ছিল। একটা ঝোঁপ থেকে থিবল্টের বর্শাটা কুড়িয়ে এনে ব্যারনের হাতে দিল সে।
কোন সন্দেহ নেই-এনগুভা হচ্ছে থিবল্টের শনি!
তৃতীয় অধ্যায় – অ্যানটে
ব্যারন নীরবে এনগুভার বাড়িয়ে দেয়া বর্শাটা নিল, উল্টেপাল্টে দেখল। ফ্রান্স ঘোরার সময়, নিজের অস্ত্র চেনার জন্য হাতলে একটা জুতো খোদাই করে রেখেছিল থিবল্ট। চিহ্নটা দেখিয়ে ব্যারন বলল, আহহা, মঁসিয়ে গোবেচারা! এই জিনিসটা তো আপনার বিপক্ষে সাক্ষী দিচ্ছে! যাই-হোক, আমি যেটা বলতে চাচ্ছি, তুই চোরাশিকার করেছিস, এটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তার উপর সত্য গোপন করেছিস, যেটা কিনা মহাপাপ। যে আত্মার নামে প্রতিজ্ঞা করেছিস, সেই আত্মার মুক্তির জন্য তোর মুখ থেকে সত্যটা আমি বের করব।
তারপর ম্যাকোটকে আদেশ করল, বদমাশটার জামা খুলে ওকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলল। তারপর ওর পিঠে ছত্রিশবার চাবুক চালাও-সত্য গোপন করার জন্য বারোটা আর চোরা শিকারের জন্য চব্বিশটা। না, বরং বারোটা চোরা শিকারের জন্য আর চব্বিশটা সত্য গোপনের জন্য হোক। ঈশ্বরের ভাগটা বেশি থাকা উচিত।
দলের লোকেরা খুশি হয়ে উঠল। যাক, ভালই হলো, সারাদিনের দুর্ভোগের ঝাল একজনের ওপর মেটানোর সুযোগ পাওয়া গেছে।
থিবল্ট বারবার বলার চেষ্টা করল হরিণ তো দূরের কথা, ও একটা ছাগলও শিকার করেনি। তা সত্ত্বেও ওর জামা খুলে গাছের সাথে বেঁধে ফেলে ব্যারনের দেয়া আদেশ কার্যকর করা শুরু হলো।
থিবল্ট চিৎকার না করার চেষ্টায় ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল। কিন্তু আঘাতগুলোতে এত জোর ছিল, যে তিন নম্বর বাড়ির পর আর চুপ থাকতে পারল না ও।
ব্যারন খুব রূঢ় স্বভাবের মানুষ হলেও থিবল্টের যন্ত্রণাকাতর আর্ত-চিৎকার সহ্য করতে এমনকি তারও অসুবিধা হচ্ছিল। নিয়মিত বিরতিতে চিৎকার চলছে। শাস্তি কার্যকর হতে দিয়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছা নিয়ে ঘোড়া ঘুরিয়ে নিল ব্যারন।