হাউন্ডগুলোর ডাক ক্রমেই কাছিয়ে আসছে। আর কিছু সময় পরে পরিকল্পনা সফল করার সুযোগ পাওয়া কঠিন হয়ে যাবে। পরিস্থিতি যত কঠিন হচ্ছে, হরিণটাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ততই তীব্র হয়ে উঠছে থিবল্টের মনে।
হরিণটা আমার চাই-ই চাই। ব্যারন ব্যাটা তো আমাকে মানুষই মনে করে! গরীবের যদি কোন ঈশ্বর থেকে থাকে তো তাকে বলছি। প্রমাণ করতে চাই যে অবস্থায়ই থাকি না কেন, আমিও মানুষ! আবার বর্শাটা তুলে দৌড় শুরু করল থিবল্ট। কিন্তু গরীবের ঈশ্বর হয় ওর কথা কানে তোলেননি আর নয়তো ওর পরীক্ষা আরও কঠিন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তৃতীয় চেষ্টাটাও বিফলে গেল বেচারার।
ঈশ্বর! অধৈর্য হয়ে উঠেছে থিবল্ট, মনে হচ্ছে ঈশ্বর কানে শুনতে পায় না! তাহলে শয়তানকেই বলি! ঈশ্বর নয় শয়তান, যে-ই শুনুক, হরিণের বাচ্চা হরিণ, তোকে আমি ধরবই!
এই দ্বিমুখী নীতিসূচক কথা শেষ করতে করতেই হরিণটা চতুর্থবারের মতো ওকে ফাঁকি দিয়ে ঝোঁপের আড়ালে হারিয়ে গেল। হাউন্ডগুলোর ডাক এত কাছে শোনা যেতে লাগল যে এই মুহূর্তে হরিণটার পিছু ধাওয়া করার চিন্তা আপাতত বাদ দিতে হলো ওকে। ঝোঁপের আড়ালে বর্শাটা লুকিয়ে একটা গাছে উঠে পড়ল ও। কুকুরগুলো এখনও গন্ধ খুঁজে যাচ্ছে। আর ওগুলোর পেছন পেছনই এসে হাজির হলো ব্যারন। লর্ড ভেযের মেজাজ যারপরনাই খারাপ হয়ে আছে। রাগের চোটে এমন হন্তদন্ত হয়ে চলাফেরা করছে সে, যে পঞ্চান্ন বছর বয়স হলেও হাবভাব দেখে বিশ বছরের যুবক বলে মনে হচ্ছে তাকে।
সামান্য একটা হরিণের পেছনে চার-চারটা ঘণ্টা খরচ করেও ধরা যাচ্ছে না। এমনটা আগে কখনও হয়নি।
লোকদের তাড়া দিচ্ছে ব্যারন, কুকুরদের ওপর চালাচ্ছে চাবুক; স্পরের নির্মম খোঁচায় আগেই ঘোড়াগুলোকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। সেতু পেরোতেই কুকুরগুলো আবার হরিণটার গায়ের গন্ধ খুঁজে পেল।
খুশিতে শিঙায় ফুঁ দিল ব্যারন।
কিন্তু খুশিটা বেশিক্ষণ টিকল না।
কারণ থিবল্টের গাছের নিচে এসেই যাদুমন্ত্রের মতো থেমে গেল কুকুরগুলো। কর্তার হুকুমে ঘোড়া থেকে নেমে হরিণটার পায়ের ছাপ খুঁজতে শুরু করল ম্যাকোট, এনগুভা এবং অন্যরা। ওদিকে কুকুরগুলোও গাছে কাছ থেকে সরতে নারাজ। অনেক খুঁজেও কোন ছাপ বের করতে পারল না কেউ। কুকুরগুলোকে নড়ানোর চেষ্টা করেও বিফল হলো ওরা। সবাইকে ছাপিয়ে শোনা গেল ব্যারনের রাগান্বিত কণ্ঠ।
বজ্জাত কুকুরগুলো কি গর্তে গিয়ে পড়ল না কি, ম্যাকোট?
না, মাই লর্ড। এখানেই আছে। কিন্তু নড়াচড়া করছে না।
কী বলছ! নড়াচড়া না করে দাঁড়িয়ে থাকবে কেন শুধু শুধু?
কী করব, মাই লর্ড? ঘটনা যে কী ঘটছে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
দাঁড়িয়ে পড়েছে। এগোচ্ছে না! তা-ও এই বনের মধ্যে! যেখানে গন্ধ হারানোর জন্য না আছে নদী না আছে পাহাড়তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে, ম্যাকোট!
আমার মাথা খারাপ হয়েছে, মাই লর্ড?
হ্যাঁ, তুমি একটা গর্দভ আর তোমার কুকুরগুলো সব বেহুদা জঞ্জাল।
নিজের ওপর সব অপমান নীরবে হজম করতে অভ্যস্ত ম্যাকোট, কিন্তু প্রাণ প্রিয় কুকুরের ওপর আক্রমণটা আর সহ্য হলো না ওর। মুখের ওপর প্রশ্ন করে বসল, জঞ্জাল, মাই লর্ড? আমার কুকুরগুলো সব বেহুদা জঞ্জাল! আপনার আস্তাবলের সেরা ঘোড়াটাকে নেকড়ে মেরে ফেলল। সেই নেকড়েটাকে তাড়িয়ে এনেছিল যারা, তারা জঞ্জাল!
হ্যাঁ, আবারও বলছি, বেহুদা জঞ্জাল! একটা হরিণের পিছনে এত ঘণ্টা তাড়া করে এসে হঠাৎ চুপ হয়ে গেল, জঞ্জালই তো!
ম্যাকোট পরিষ্কার কিন্তু কিছুটা দুঃখ মেশানো স্বরে বলল, মাই লর্ড, আমাকে বোকা, গাধা, মাথামোটা, অপোগন্ড যা খুশি বলুন; এমনকি আমার বউ, বাচ্চাদেরকেও যত খুশি অপমানসূচক কথা বলুন, কিছু মনে করব না আমি; কিন্তু এতদিন ধরে নিষ্ঠার সাথে আপনার চাকরি করছি, তার খাতিরে হলেও দয়া করে আমার কাজকে, আপনার কুকুরগুলোকে অপমান করবেন না।
তাহলে ওদের এই হঠাৎ থেমে যাওয়ার ব্যাখ্যাটা কী? বলল কী ব্যাখ্যা, আমি শুনতে রাজি আছি।
আপনার মতোই আমারও কোন ধারণা নেই, মাই লর্ড। হরিণটা হয় আকাশে, নয় পাতালে মিলিয়ে গেছে।
কী আজেবাজে বকছ? হরিণটার কি পাখা গজিয়েছে যে উড়ে যাবে, না কি খরগোশের মতো গর্তে লুকাবে?
ওটা তো কথার কথা বললাম, মাই লর্ড। আসল কথা হচ্ছে, এর পেছনে কোন জাদুর কারসাজি আছে। কথা নেই বার্তা নেই সবগুলো কুকুর একসাথে গন্ধ শোঁকা বাদ দিয়ে শুয়ে পড়ল। আপনার কাছে এটাকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?
চাবকে ওগুলোর পিঠের চামড়া তুলে ফেলল তাহলে! ভূত তাড়ানোর এর চেয়ে ভাল রাস্তা আর নেই।
আদেশ দিয়ে নিজেও এগিয়ে গেল ব্যারন। ম্যাকোট আদেশ পালন শুরু করল। এনগুভা হ্যাটটা হাতে নিয়ে ব্যারনের কাছে এগিয়ে এল। ঘোড়ার লাগামে হাত রেখে বলল, মাই লর্ড, এইমাত্র গাছের পাতার আড়ালে একটা কোকিল দেখলাম। মনে হচ্ছে ওর কাছ থেকে ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে।
কোকিল, কী আবোল তাবোল বকছিস, বানর কোথাকার? দাঁড়া, অনর্থক আমাকে বিরক্ত করতে আসার মজা তোকে টের পাওয়াচ্ছি। চাবুক তুলল ব্যারন। এনগুভা মাথার ওপর হাত তুলে নিজেকে আড়াল করে বলল, মারতে চাইলে মারবেন, মাই লর্ড। কিন্তু একবারটি উপর দিকে তাকান। গাছের ডালে বসা পাখিটাকে দেখলে চাবুকের বাড়ি নয়, আমাকে পুরস্কার দিতে চাইবেন।