‘তোমরা, তোমরা গত পরশু রি ফেরোয় এক ফ্যারাস অনুষ্ঠানে দাঙ্গা বাঁধিয়েছিলে? অস্বীকার করতে পারবে না, আমি জানতে পেরেছি, সেই সময় কার্ডিনাল-এর সৈন্যবাহিনী তোমাদের গ্রেফতার করে।’ রাগে উন্মত্ত হয়ে মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল তাদের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘অ্যাথোস, অ্যাথোস কোথায়? তাকে দেখা যাচ্ছে না কেন?’ প্যাথোস বলে উঠল, ‘মঁসিয়ে অ্যাথোসের শরীর অসুস্থ। সে খুবই অসুস্থ হয়ে পরেছে। সম্ভবত তার গুটি বসন্ত হয়েছে।’
‘বাঃ! চমৎকার খুব সুন্দর গল্প বলতে শিখেছ তো? অ্যাম্বোস নিশ্চয়ই ঐ দাঙ্গায় মারাত্মক জখম হয়েছে কিংবা মারাই গিয়ে থাকবে হয়তো।
‘মঁসিয়ে তাহলে সত্যি কথাই বলি, সে দিনের ওই দাঙ্গায় আমরা দাঙ্গা বাঁধাবার আগেই কার্ডিনাল-এর সৈন্যরা আচমকা আমাদের আক্রমণ করে। এর ফলে আমাদের দলের দু-জন মারা যায়। আর অ্যাম্বোস মারাত্মক জখম হয়। তবে ওদের মধ্যে একজনকে আমি তার তলোয়ার দিয়েই আঘাত করি এবং তাতে সে মারা যায়। আমার নিজের তলোয়ারটা দাঙ্গার প্রথমেই ভেঙে যায়।’ প্যাথোস এই বলে চোখ দুটো নামিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ঠিক সেই সময় ব্যান্ডেজ বাঁধা শ্লথ পায়ে অ্যাম্বোস এল। অ্যাথোস তুমি! সমস্বরে বলে উঠল প্যাথোস আর এ্যারামিস। এদের সাথে সাথে মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলকে অ্যাথোস বলে উঠলেন ‘মঁসিয়ে আপনি আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন সেটা শোনা মাত্রই আমি আপনার কাছে এসেছি। সামান্য যদি বিলম্ব হয়ে থাকে সেটা আমার ক্লান্তি আর অসুস্থতার জন্য হয়েছে।
মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল অ্যাথোসকে আপাদমস্তক দেখে তার দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেন। খুব শান্ত ও আবেগপূর্ণ স্বরে তাদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘দেখো বন্ধুরা, তোমরা ভালোভাবেই জানো সৈন্যবাহিনী থেকে উপযুক্ত দক্ষ সৈন্য নিয়েই রাজার জন্য এই রক্ষী বাহিনী গঠন করতে হয়। এই সাহসী বীরেরা অনর্থক তাদের নিজেদের জীবনটা অপচয় করুক এটা আমাদের কাম্য নয়। এই বীরেরা সত্যি সত্যিই পৃথিবীতে বিরল।’
কয়েক পা আরো এগিয়ে মঁসিয়ে ট্রেভিল খুব আন্তরিকতার সাথে অ্যাথোসের হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে করমর্দন করলেন। বেচারা। অ্যাথোস! মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলের আন্তরিকতার চোটে তার হাতের ব্যথা এতই বেড়ে গেল যে বিড় বিড় করে কিছু একটা বলে কোনো ক্রমে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল।
সবাই চলে যেতে মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল নিজের চেয়ারের দিকে এগিয়ে এলে আসতে গিয়ে মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁনের দিকে চোখ পড়ল, আর সাথে সাথে মৃদু হেসে বললেন, ‘বন্ধু আমি তোমার কাছে মাপ চাইছি। বাস্তবিক আমি তোমার কথা ভুলে গিয়েছিলাম আর সেজন্য আর একবার মাপ চাইছি। হ্যাঁ তোমার বাবাকে আমি চিনি, তিনি আমার কাছে খুব সম্মানীয় ছিলেন। আমি তাঁর ছেলের জন্য কি করতে পারে?’
যুবক মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন তার ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করল, বলল ‘আমি রাজার একজন বন্দুকধারী সৈন্য হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত করতে চাই।’
‘কিন্তু রাজার বন্দুকধারী সৈন্য হিসেবে এ-রকম ভাবে সরাসরি কাউকে নিয়োগ করা হয় না। আগে সৈন্যবাহিনীতে কৃতিত্বের সাথে তাকে কয়েকটা যুদ্ধ করতে হয় আর তাছাড়া দু-বছর তাকে সৈন্যবাহিনীতে অবশ্য শিক্ষা নিতে হয়।’ মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল বললেন।
এই কথা শুনে যুবক অ্যাট্রাগঁন পিতৃবন্ধু ও ক্যাপ্টনকে অভিবাদন করে চলে যাবার জন্য উঠলে, মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল তাকে ডাকলেন এবং স্মিত হেসে বললেন।
‘তুমি আমার বন্ধু ও পূর্বতন সহকর্মীর ছেলে সুতরাং আমার কর্তব্য তোমায় কিছু অর্থ সাহায্য করা। কেন না আমার মনে হয় তুমি যথেষ্ট অর্থ নিয়ে এত দূরে আসেনি।’
যুবক অ্যাট্রাগঁন বলল,–‘ধন্যবাদ মঁসিয়ে আমি কারো কাছে অর্থ সাহায্য আশা করি না।’
‘বাঃ! এটা খুব ভালো। তুমি জেনে খুশি হবে যে আমি মাত্র চার ক্রাউন নিয়ে প্যারিস শহরে এসেছিলাম।’ মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল বললেন। ‘তবু আমি তোমার জন্য কিছু করতে চাই। আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি রয়েল একাডেমি-র অধ্যক্ষকে। আগামীকালই উনি তোমায় ওই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার জন্য ভর্তি করে নেবেন এবং তার জন্য তোমার কোনো খরচ হবে না। ওহে যুবক আমার এই সামান্য সাহায্য তুমি প্রত্যাখান করো না। সেখানে তোমায় ঘোড়ায় চড়া, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় অসি চালনা এবং তার সাথে নাচটাও শিখিয়ে দেবে আর তুমি মাঝে মাঝে আমায় জানিয়ে যাবে তোমার শিক্ষার অগ্রগতি কেমন হচ্ছে।’
কথা প্রসঙ্গে অ্যাট্রাগঁন মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলকে জানাল কীভাবে তার বাবার দেয়া চিঠিটা চুরি হয়ে যায়। সব শুনে দ্য ট্রেভিলন বললেন,–‘দেখ, ওই কাটা দাগওলা লোকটা যে তোমার চিঠি চুরি করেছে এবং সেই ইংরেজ মহিলা যার নাম মেলেডি এরা হচ্ছে ভয়ঙ্কর। এদের সুন্দর রূপের ভেতর রয়েছে শয়তানের বাসা। আমি তোমায় সাবধান করে দিচ্ছি যদি দেখ ওই সুপুরুষ কপালের দুই দিকে কাটাদাগওলা তোমার সামনে দিয়ে আসছে তুমি সাথে সাথেই অন্য রাস্তায় সরে যাবে।’
‘ক্যাপটেন আমি ভীতু নই। আপনার এই সাবধান বাণী হয়তো আমি মানতে পারব না।’ এই বলে ক্যাপটেনের লেখা রয়েল একাডেমি-র চিঠিটা নিয়ে সে দ্রুত চলে গেল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বের হবার পথে তার সাথে সেই তিনজন মাসকেটিয়ার্সের সাথে দেখা হয়ে গেল। তাদের চোখে মুখে তখনও তিরস্কৃত হওয়ার লজ্জা রয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শীই সে ঘটানার একমাত্র এই দ্য অ্যাট্রাগঁন। এই তিরস্কারের কথা যদি বাইরে প্রচার হয়ে যায় সেটা তিন যোদ্ধার কাছে কখনই সুখপ্রদ হবে না। সুতরাং তারা মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁনকে বাঁধা দিল এবং জানাল তাকে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করতে হবে। দ্য অ্যাট্রাগঁনের সাথে এই তিনজনের দেখা হয় একই দিনে কিন্তু বিভিন্ন সময়ে। যখন দ্য অ্যাট্রাগঁন নির্দিষ্ট সময়ে অ্যাথোসের সাথে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করার জন্য উপস্থিত হলো, তখন অ্যাথোস, প্যাথোস ও এ্যারমিস দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল যে একই ব্যক্তি তিনজনের সাথে একই দিকে এক ঘণ্টার তফাতে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করার জন্য উপস্থিত। কিন্তু দমে যাবার চরিত্র ছিল না মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁনের। দ্য অ্যাট্রাগঁন বলল—’ভদ্র মহাশয় আমায় ক্ষমা করতে হবে।’