‘ঠিক, তুমি ঠিকই বলেছ, বোকার মতো উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়; যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি এই জায়গা ছেড়ে চলে যাচ্ছি,’ এই কথা বলে সেই কপালে দাগওলা লোকটা লাফিয়ে তার ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল এবং দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। অবশ্য তার আগে মহিলাকে অভিবাদন জানাতে ভুলল না।
লোকটা চলে যাবার সাথে সাথেই মিলেডি কোচম্যান নরম্যান ঘোড়া দুটোকে চাবুক চালাতেই সে দু-টো ধূলো উড়িয়ে নিমেষেই অদৃশ্য হলো।
‘কাপুরুষ’ বলে সামনের দিকে খোলা তলোয়ার নিয়ে লাফিয়ে যেতেই মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন বুঝতে পারল তার ক্ষতস্থান থেকে আবার রক্ত ঝরছে তাই শরীরটা দুর্বল লাগছে।
সে দিনটা মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন সরাইখানাটাতে থেকে যেতে বাধ্য হলো। পরের দিন সকালে ঘঁসিয়ে সুস্থ হতে প্যারিস যাবার জন্য তৈরি হতে লাগল। সরাইখানায় পয়সা মেটাতে গিয়ে দেখল যে তার পকেট ফাঁকা, সমস্ত কিছুই চুরি হয়ে গিয়েছে।
সরাইখানার মালিকের উদ্দেশ্য হুংকার করে উঠে মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন বলল ‘কোথায় গেল আমার চিঠিটা? আপনাকে সতর্ক করে দিয়ে বলছি যে ওটা মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলের উদ্দেশ্যে লেখা। ওটা খুঁজে আমায় পেতেই হবে।’
মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁনের এই হুংকারে সরাইখানার মালিক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘চিঠিটা কি খুবই দরকারি?’
‘দরকারি মানে? এটার ওপর আমার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।’
মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রগঁনের মুখে রাজা ও তাঁর রক্ষী বাহিনির প্রধান মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলের নাম শুনে সরাইখানার মালিক বিপদের আঁচ করে এবং নিজেকে বাঁচাবার জন্য বলল, ‘মঁসিয়ে আপনার চিঠিটা হারিয়ে যায়নি, ওটা চুরি হয়ে গিয়েছে।
‘চুরি হয়ে গিয়েছে?’
‘বলো কে চুরি করেছে?
‘সেই লোকটা যার কপালের দু-দিকে কাটা দাগ, …তাহলে খুলেই বলি, গতকাল অজ্ঞান হবার আগে যখন মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলের কাছে অভিযোগ জানাবার কথা বলছিলেন, তখনই সেটা শুনে সেই কাটা দাগওলা লোকটা সতর্ক হয়ে ওঠে এবং তারপরই দেখি যেখানে আপনার পশমের গাউনটা খোলা ছিল সেখানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে আমার দৃঢ় বিশ্বাস ওই লোকটাই আপনার চিঠি চুরি করেছে।’
‘প্যারিসে গিয়েই মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলকে আমি এই কথা জানাবো। তিনি নিশ্চয়ই রাজার কানে কথাটা তুলবেন। তখন বুঝতেই পারছেন কি অবস্থা হবে কাটা দাগওলা লোকটার?’ এই বলে মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন টাকা মিটিয়ে রাস্তায় নামলেন।
না তার টাট্টু ঘোড়া পথে আর কোনো ঝামেলা করেনি। প্যারিসে ঢোকার মুখে তিন ক্রাউনে তার টাটুটা বেচে হেঁটেই সে প্যারিস শহরে ঢুকল। এখন আর টাটুকে নিয়ে কারো আর হাসার কারণ রইল না।
মঁসিয়ে ট্রেভিল রাজা ত্রয়োদশ লুইসের খুব নিকট বন্ধু। সেই অরাজকতার দিনে ফ্রান্সের রাজাদের তাঁর পাশে সর্বক্ষণ থাকার জন্য সাহসী ও দক্ষ যোদ্ধার প্রয়োজন হতো। যারা সকল সময়ই তাদের প্রিয় রাজার পাশে থেকে রাজাকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করত, মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলও ছিলেন একজন অসীম সাহসী যোদ্ধা ও রাজার প্রিয় বন্ধু। মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলের নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু সংখ্যক সাহসী যোদ্ধা ছিল যারা নিজের জীবন তুচ্ছ করে রাজাকে রক্ষা করার জন্য প্রস্তুত থাকত।
কার্ডিনাল রিচেলিউ ছিলেন দেশের একজন সর্বশক্তিমান পুরুষ এবং তিনি নিজেকে রাজার সম-ক্ষমতাসম্পন্ন ভাবতেন। ঠিক রাজারই মতো এই কার্ডিনাল রিচেলিউ–এরও নিয়ন্ত্রণে কিছু দক্ষ সৈন্য থ ত এবং তারাও কার্ডিনালকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য সদা প্রস্তুত থাকত। বলাবাহুল্য এই সব সৈনিকেরা সাধারণ সৈনিকের মতো বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল। রাজা এবং কার্ডিনাল দুজনেই তাদের এই সুশিক্ষিত দক্ষ যোদ্ধাদের নিয়ে একজন আর একজনকে টেক্কা দেবার চেষ্টা করত।
মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলেরও এক সময় খুব খারাপ অবস্থা ছিল অনেকটা মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁনের মতোই। কপর্দক শূন্য অবস্থায় তিনিও প্যারিসে এভাবেই এসেছিলেন কিন্তু নিজের সাহসিকতায়, বুদ্ধিমত্তায় এবং চাতুর্যে তিনি এখন রাজার সৈন্যবাহিনী থেকে বাছাই করা যোদ্ধা নিয়ে গঠিত রাজার যে রক্ষী বাহিনী তার প্রধান।
মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলের প্রধান কার্যালয়ে যখন সিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন প্রবেশ করল, সেই বিরাট প্রসাদের আবহাওয়া দেখে মঁসিয়ে হকচকিয়ে গেল। চতুর্দিকেই যেন যুদ্ধের প্রস্তুতি। বিরাট দরজার ভেতর দিয়ে যখন আরো ভেতরে পৌঁছাল দেখল চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাজার একান্ত বিশ্বাসী দক্ষ সৈনিকেরা নিজেদের মধ্যে অসি যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছে, তলোয়ারের সেই শব্দে মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁনের বুকের রক্ত লাফিয়ে উঠল। একজন ভৃত্য এসে তার কাছে জানতে চাইল এখানে তার আসার উদ্দেশ্য কি? মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁনের নাম বলল এবং অনুরোধ জানাল যেমন মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল যেন তাকে অল্প। সময়ের জন্য হলেও অবশ্যই তার সাথে সাক্ষাৎ করার অনুমতি দেন।
মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁনের প্রার্থনা মঞ্জুর হলো, ভৃত্যটি এসে তাকে সিয়ে দ্য ট্রেভিলের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল।
মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলের ঘরে ঢুকে মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন দেখতে পেল সেনা-নায়কের মেজাজ খুব চড়া, তবুও তিনি মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁনকে সৌজন্য দেখিয়ে বললেন, ‘মঁসিয়ে আপনি দয়া করে সামান্য সময় অপেক্ষা করুন আমি কয়েকজনের সাথে একটা জরুরি কথা সেরে নিই।’ এই বলে মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল চিৎকার করে তিনটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করলেন ‘এ্যাথোস, প্যাথোস, এ্যারামিস!’ সাথে সাথেই শেষের দু-জন উপস্থিত হয়ে অভিবাদন জানাল তাদের নেতা মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিলকে।