অ্যাট্রাগঁন বলল–‘হ্যাঁ মঁসিয়ে আমার সব কিছুই মনে থাকবে।’
দ্য অ্যাট্রাগঁন ডিউককে অভিবাদন জানিয়ে তাড়াতাড়ি প্যারিস পৌঁছার জন্য রওনা দিল। ‘সান্ড’ বন্দর থেকে দ্য অ্যাট্রাগঁন জেলেদের জন্য ছোট বন্দর সেন্ট ভ্যালেরিতে পৌঁছে সাঙ্কেতিক শব্দে এনাভেন্ট বলল ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের ছেলেটাকে। এরপর ডিউক যেমনটি বলেছিলেন সেইমত জেলেটা দ্য অ্যাট্রাগঁনকে নিয়ে এলো একটা আস্তাবলে, একটি শক্তিশালী ঘোড়া রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিল। জেলেটি জানতে চাইল তার আর কিছু দরকার আছে কিনা?
‘হ্যাঁ মঁসিয়ে প্যারিস যাবার সহজ পথটা আপনার কাছে আমি জানতে চাইছি!’ বলল অ্যাট্রাগঁন।
‘এখান থেকে সোজা পথে চলে যান বালাঞ্জি আর বালাঞ্জি থেকে নিউচ্যাটেল সেখানে আপনার জন্য আর একটা ঘোড়া তৈরি থাকবে। আপনি এই ক্লান্ত ঘোড়াটার পরিবর্তে তাজা ঘোড়াটায় চেপে রওনা দেবেন।’ জেলেটি মুখস্ত বলে গেল।
মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন হাওয়ার গতিতে ঘোড়া চালিয়ে বারো ঘণ্টায় ১৮০ মাইল পথ ঘোঢ়া ছুটিয়ে যখন সিয়ে দ্য ট্রেভলির দপ্তরে পৌঁছাল তখন সকাল ন-টা।
মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল অ্যাট্রাগঁনকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন-‘মঁসিয়ে দ্য অ্যাসার্টর্স এখন লুভেতে কর্মরত। তুমি তার কাজে যোগ দাও এখনই। মনে রাখবে সকলে যেন এইটাই বোঝে ছুটি কাটিয়ে তুমি কাজে যোগ দিয়েছ।’
অভিবাদন জানিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন কাজে যোগ দিতে চলে গেল, গত সাত দিন প্যারিস শহরে সকলের মুখেই বল নাচের অনুষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। রাজা রানী সেখানে অংশগ্রহণ করবেন, সাত দিনেরও বেশি সময় ধরে হোটেল ডি ভ্যালি সজ্জিত হয়েছে ফুল আর শয়ে শয়ে মোমবাতি দিয়ে।
বল নাচের নির্দিষ্ট সময়ের আগে রাজা এয়োদশ লুই–যখন পথ দিয়ে হেঁটে অনুচরবর্গ সহকারে হোটেলে প্রবেশ করলেন তখন রাজভক্ত প্রজারা করতালি দিয়ে রাজাকে অভিবাদন জানাল। প্রজারা লক্ষ্য করল রাজার মুখমণ্ডল খুবই বিষণ্ণ।
হোটেলে নিজের ঘরে যাবার আগে রাজা জানতে চাইলেন কার্ডিনাল রিচেলিউ এসেছেন কিনা।
রাজা লুই হোটেলে তার নির্দিষ্ট আরামবহুল ঘরে ঢোকার পরেই প্যারিসের দুঃখী বিষণ্ণা রানী এ্যান তার সখীদের নিয়ে হোটেলে এলেন। প্রজারা করতালি দিয়ে তাঁকেও অভিবাদন জানাল।
রানীর প্রবেশের সাথে সাথেই হোটেলের একটা ছোট্ট গ্যালারির পর্দা সরে গেল, উজ্জ্বল পোশাকে সজ্জিত কার্ডিনাল রিচেলিউ ধূর্ত চোখে অনুসন্ধান করে ফিরল রানীর পোশাক পরিচ্ছদ। ধূর্ত চোখের সাথে পাল্লা দিয়ে তীক্ষ্ম জয়ের হাসি দেখা দিল কার্ডিনাল এর ঠোঁটের কোণে–রানীর গলায হীরের নেকলেস নেই।
অভিজাত বংশীয় পুরুষ মহিলারা ও উচ্চ রাজকর্মচারীরা রানীকে অভিনন্দন জানাল। রানী অভিবাদন গ্রহণ করলেন।
ঠিক সেই সময় রাজা লুই হোটেলের ঘর থেকে বল নাচের ঘরে এলেন। আর কার্ডিনালকে দেখা গেল রাজার সাথে নিচু স্বরে কথা বলতে।
কার্ডিনাল এর কথা শোনার পর, রাজা লুই গম্ভীর হয়ে গেলেন দ্রুত পায়ে রানী এ্যানের দিকে এগিয়ে গিয়ে উচ্চস্বরে রানী এ্যানকে জিজ্ঞেস করলন–‘মাদাম তুমি হীরের নেকলেসটা গলায় পরনি কেন? যখন তুমি জানো নেকলেসটা তুমি পরলে আমি আনন্দ পাই?’
রানী দেখলেন রাজার পেছনেই কার্ডিনাল, ধূর্ত শয়তানী হাসি তার সারা মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে আছে।
‘মহামান্য স্বামী’ কম্পিত স্বরে রানী বললেন–‘আমি এই ভীড়ের মধ্যে আপনার দেয়া মূল্যবান হীরের নেকলেসটা পড়তে ভরসা পাইনি। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে।’
‘না রানী তুমি ভুল করছ, আমি তোমার উপহারটা দিয়েছি যাতে তুমি ওটা পরিধান করে নিজেকে আরও সুসজ্জিত করে তুলতে পারো। চুরির ভয়ে সিন্দুকে তুলে রাখার জন্য নয়। তোমার ধারণা ভুল মাদাম।’
‘মহামান্য স্বামী, আমি নেকলেসটা লুভেতেই রেখে এসেছি, আমি এখনি কাউকে দিয়ে আনিয়ে হারটা পরছি, মহামান্য স্বামী নিশ্চয়ই তাতে খুশি হবেন!’
‘হ্যাঁ আমি নিশ্চয়ই খুশি হবো, তাড়াতাড়ি করো, আর মাত্র আধঘণ্টা বাকি আছে নাচ শুরু হতে।’
রানী তাঁর সখীদের নিয়ে হোটেলে তাঁর জন্য সংরক্ষিত ঘরে চলে গেলেন।
রাজা লুই ফিরে এসে নিজের আসন গ্রহণ করলেন, কার্ডিনাল রিচেলিউ রাজার পাশে বসে ছোট্ট সুন্দর একটা বাক্স বার করে রাজার হাতে দিল। রাজা বাক্সটা খুলে দেখলেন তাতে দুটো হীরে।
‘এর মানে কি?’ আশ্চর্য হয়ে রাজা প্রশ্ন করলেন কার্ডিনালকে, ধূর্ত কার্ডিনাল বলল, ‘কিছুই না, তারপর আস্তে আস্তে বলল, ‘রানীর যখন হীরের নেকলেসটা পরে আসবেন, খুব সম্ভব তিনি হয়তো সেটা পরে আসতে পারবেন না, যদি আসেন মহামান্য রাজাকে অনুরোধ করছি হীরের নেকলেসে হীরের বোতাম আছে আপনি শুনে দেখবেন।’
‘আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না’ রাজা বললেন, ‘মহামান্য রাজা’ কার্ডিনাল রিচেলিউ বলল–‘আমার ধারণা রানী যদি হীরের হারটা পরেই আসেন তাতে বারোটার পরিবর্তে দশটা হীরের বোতাম থাকবে, আর তখনই মহামান্য রাজা আপনি এই হীরে দুটো দেখিয়ে জানতে চাইবেন। রানীর হার থেকে চুরি যাওয়া হীরে দুটো এখানে কি করে এলো?’
হতবাক রাজা কার্ডিনালকে কিছু প্রশ্ন করার সময় হলো না। রাজা শুনলেন বল নাচ ঘরের উপস্থিত সকলের মুখে প্রশংসা সূচক শব্দ। মহামান্য রাজা লুই ত্রয়োদশ যদি তাঁর রাজ্যের সর্বপ্রধান সম্মানীয় ব্যক্তি তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় রানী অ্যান ফ্রান্সের সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা। রাজা দেখলেন রানীর গলায় শোভিত হচ্ছে তাঁর উপহার দেয়া সেই হীরের নেকলেসটা। রাজার মনে হলো হীরের হারটা তাঁর স্ত্রী রানী অ্যানকে শোভিত করেনি, রানীর গলায় হীরেটাই যেন নিজেকে শোভিত করেছে।