পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে ভদ্রলোক বলল, ‘ক্যাপটেন এই চিঠিটা দেখুন, এটাতে কার্ডিনালের অনুমতি আছে।’
‘ধন্যবাদ, কিন্তু মহাশয় বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আপনাকে এটা পরীক্ষা করে আনতে হবে।’ জাহাজের ক্যাপটেন বললেন।
‘কিন্তু মহাশয় আমি বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে কোথায় দেখা পেতে পারি?’ ব্যস্ত লোকটা প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ আপনি বন্দর কর্তৃপক্ষকে ওঁনার বাড়িতে পাবেন সামান্যই দূরে, ওই যে দুরে কালো পাথরের ছাদওলা বাড়ি দেখতে পাচ্ছেন, ওইটেই কর্তৃপক্ষের বাড়ি।’
জাহাজের ক্যাপটেনকে ধন্যবাদ জানিয়ে ব্যস্ত ভদ্রলোক দ্রুত বন্দর কর্তৃপক্ষের বাড়ির দিকে রওনা হলো। এদিকে অন্য কোনো উপায় না দেখে। দ্য অ্যাট্রাগঁন চুপিসারে গাছের আড়াল দিয়ে সেই ভদ্রলোককে অনুসরণ করল। একটা নির্জন জায়গায় এসে গাছের আড়াল থেকে হঠাৎ বেড়িয়ে এসে লোকটির কাছ থেকে ইংল্যান্ড যাবার অনুমতি পত্রটা কেড়ে নিল অ্যাট্রাগঁন। এর জন্য অবশ্য তাকে তিনবার লোকটার গায়ে তরোয়ালের আঘাত দিতে হয়েছিল। তিনটে আঘাত তিনজনের নামে উৎসর্গ করেছিল সে। প্রথমটা অ্যাসোথের, দ্বিতীয়টা প্যাথোস আর তৃতীয়টা এ্যারামিসের নামে। বন্দর কর্তৃপক্ষকে নিজে একজন কার্ডিনাল-এর অনুচর বলে পরিচয়। দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ মিটিয়ে অ্যাট্রাগঁন অন্য পথ ধরে বন্দরে এসে পৌঁছাল। একটা জাহাজ ভাড়া করে বন্দর ত্যাগ করে ইংল্যান্ডের দিকে রওনা হলো। কিছুটা দূর যাবার পরই একটা কামানের গোলা পড়ার শব্দ হলো। শব্দটার অর্থ হলো সমস্ত ফেরি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হলো, ক্লান্ত অ্যাট্রাগঁন ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাল–‘আমিই বোধহয় শেষ যাত্রী। আর সামান্য দেরি হলেই আমার জাহাজও বন্দর ছাড়তে পারতো না।’ মনে মনে ঈশ্বরকে আর একবার ধন্যবাদ জানিয়ে ক্লান্ত অ্যাট্রাগঁন শুয়ে পড়ল–‘আপাতত আমি নিরাপদ। সামান্য ঘুমিয়ে নেয়া যাক, এরপর হয়তো ঘুমাবার সময়ই পাবো না।’
সকাল দশটায় জাহাজ ইংল্যান্ড উপকূলে ডোভার বন্দরে নোঙর ফেলল আর এক আধঘণ্টা পরই অ্যাট্রাগঁন ইংল্যান্ডের মাটিতে পা রাখল। তারপর একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করল মঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন ইংরেজি ভাষার একটা বর্ণও জানে না অ্যাট্রাগঁন। তবে বাকিংহামের ডিউকের নামের বানানটা অনেক কষ্টে রপ্ত করেছিল। একটা কাগজে বাকিংহামের নামটা লিখে রাস্তায় তার সামনে যারই দেখা হতে লাগল তাকেই সেই কাগজের লেখাটা দেখাতে লাগল, এভাবে অনেক মেহনত করে অ্যাট্রাগঁন ডিউকের প্রাসাদে এসে পৌঁছল। কিন্তু সেখানে এসে জানতে পারল ডিউক সেখানে নেই, তিনি উইন্ডসরে গিয়েছেন রাজার সাথে শিকার করতে। প্যাট্রিক নামে এক ভৃত্য দ্য অ্যাট্রাগঁনকে নিয়ে গেল উইন্ডসরে।
সে বলল, ‘মহাশয় আপনি অপেক্ষা করুন আমি মহামান্য বাকিংহামের ডিউককে আপনার আগমন বার্তা জানাচ্ছি। কিন্তু তাঁর কাছে আপনার পরিচয়টা কি দেব যদি বলে দেন?’ প্যাট্রিক বলল।
‘তুমি গিয়ে বলবে প্যারিসে লুভেরের কাছে যে ব্যক্তির সাথে তাঁর ঝগড়া হয়েছিল, সেই এসেছে দেখা করতে।’
প্যাট্রিকের কাছে খবরটা শুনেই বাকিংহাম বুঝতে পারলেন ফ্রান্সে নিশ্চয়ই কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে, মুহূর্ত বিলম্ব না করে তিনি দ্য অ্যাট্রাগঁন ডেকে পাঠালেন।
ভালোবাসা, উদ্বেগ আর ভয়ে বাকিংহাম বললেন–‘আমি আশা করতে পারি রানীর কোনো অনিষ্ট হয়নি?’
‘না মহাশয় অনিষ্ট এখনো হয়নি তাঁর, তবে বোধহয় হতে চলেছে, আর আমার মনে হয় একমাত্র আপনিই তাঁকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন।’
‘আমি? তোমাদের রানীকে আমি বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারি? বলো বালো আমি তাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারি? খুব সামান্য সুযোগও যদি পাই তাকে উদ্ধার করার, তাহলেও আমি নিজেকে ধন্য মনে করব।’
‘এই নিন মঁসিয়ে ডিউক, এই চিঠিটা রানী আপনাকে দিয়েছেন।’
‘রানী এ্যান আমাকে চিঠি দিয়েছে।’ রানীর কোনো অজানা বিপদের আশংকায় বিবর্ণ হয়ে উঠল বাকিংহামের মুখ, কম্পিত হাতে চিঠি খুলে পড়লেন।
চিঠি পাঠ করার পর রানীর বিপদটা কোথায় বুঝতে পারলেন ডিউক চিৎকার করে তিনি ডাকলেন,–‘প্যাট্রিক! প্যাট্রিক! এখুনি রাজার কাছে যাও তাঁকে বলো বিশেষ জরুরি দরকারে আমাকে এখনি লন্ডন চলে যেতে হচ্ছে, আমার এই হঠাৎ চলে যাওয়ার জন্য তাঁকে বলো–আমি আন্তরিক দুঃখিত।’
প্যাট্রিককে নির্দেশ দিয়ে ডিউক বাকিংহাম দ্য অ্যাট্রাগঁনকে নিয়ে দ্রুত লন্ডনের দিকে রওনা হলেন।
ঘোড়া থেকে নেমে প্রায় ছুটতে ছুটতে ডিউক দ্য অ্যাট্রাগঁনকে নিয়ে তার শোবার ঘরে নিয়ে গেলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তিনি বসে পড়লেন একটা ছবির সামনে। তার বসার ভঙ্গিটা ছিল প্রার্থনা করার মতো, ছবিটা ঢাকা দেয়া ছিল পার্সিয়ান মখমলের ওড়না দিয়ে, তাতে সূক্ষ সোনার কাজ করা, ওড়না সরাতেই মোমের মিষ্টি আলোয় দ্য অ্যাট্রাগঁন ছবির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন–রানী এ্যানের একটা পূর্ণ প্রতিকৃতি। কি জীবন্ত ছবি–মনে হচ্ছে যেন এখনি ছবি থেকে বেরিয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়াবেন। ছবিটার তলাতেই ছিল সুন্দর কারুকাজ করা একটা কাঠের সিন্দুক বাকিংহাম সেই সিন্দুক খুলে তার মধ্য থেকে আর একটা ছোট্ট বাক্স বার। করলেন। বাক্স খুলতেই হীরের দ্যুতিতে চতুর্দিক ঝলমল করে উঠল। ‘এই নাও ঘঁসিয়ে দ্য অ্যাট্রাগঁন’ এই হীরের নেকলেস রানী আমায় দিয়েছিলেন, এখন আবার তাঁর এটা প্রয়োজন পড়েছে, তার সব ইচ্ছে পূর্ণ হবে। বাক্স থেকে হারটা বার করে দ্য অ্যাট্রাগঁনের হাতে দেবার মুহূর্তেই ডিউক চিৎকার করে বলে উঠলেন–‘সব শেষ হয়ে গেল,’ ডিউক কপাল চাপড়ে বললেন ‘সব শেষ রানীকে বিপদ থেকে বাঁচাতে পারলাম না বোধহয়।’ হতভম্ব দ্য অ্যাট্রাগঁন জিজ্ঞেস করল ‘কি হয়েছে মহামান্য ডিউক?’