মঁসিয়ে দ্য ট্রেভিল সব শুনে বললেন–‘সাহসী যুবক, তোমার কি মনে হয় তোমার এই লন্ডন যাত্রায় কোথা থেকে কি বাধা আসতে পারে?’
‘হ্যাঁ মঁসিয়ে আমার স্থির বিশ্বাস কার্ডিনাল-এর লোকেরা আমায় বাধা দেবে, কেন না তারা জানে কেউ একজন রানীর চিঠি নিয়ে লন্ডন রওনা হচ্ছে।’
‘ঠিক–আমারও মনে হয় কার্ডিনাল-এর চরেরা তোমাকে বাধা দেবে, সেক্ষেত্রে আমার মতে অ্যাথোস, প্যাথোস, এ্যারোমিস আর তুমি তোমরা চারজন যাও। তোমাদের যে কেউ যেন লন্ডনে বাকিংহামের কাছে ঠিক সময়ে ফৌছতে পারে। মনে রেখ, কোনো বাধা হলে তার মোকাবেলা করার জন্য মাত্র একজনই থাকবে। এভাবে শেষ জন যেন লন্ডন পৌঁছতে পারে। পথে অযথা সময় নষ্ট করবে না। আমি তোমাদের চারজনেরই ছুটি মঞ্জুর করলাম।’
অ্যাম্বোস, প্যাথোস এবং এ্যারামিস তিনজনেই দ্য অ্যাট্রাগঁনের কাছ থেকে তাদের এই ছুটির কারণটা কি জানতে পেরে খুব উৎসাহী হয়ে উঠল।
সেদিনই দু-টোয় চার বন্ধু প্যারিস ছেড়ে লন্ডনের দিকে রওনা হলো। রাস্তায় কোনো বিপদ ঘটল না। পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ তারা চ্যানটিলি নামে এক শহরে পৌঁছে কিছু খেয়ে নেবার জন্য তারা চার বন্ধু একটা হোটেলে ঢুকলো। হোটেলের যে টেবিল ঘিরে চারবন্ধু খাচ্ছিল, ঠিক সেই টেবিলেই এক আগন্তুক এসে বসল। সুন্দর সকাল আর আবহাওয়া। নিয়ে কথা বলার পর আগন্তুক জানাল তার তাড়া আছে এবং মঁসিয়ে প্যাথোসকে বলল—
‘আসুন মঁসিয়ে আমার তাড়া আছে, আমাকে এখনি চলে যেতে হবে তার আগে আমার প্রভু মঁসিয়ে কার্ডিনাল-এর স্বাস্থ্য কামনা একপাত্র সুরা পান করি।’
‘আমি নিশ্চয়ই আপনার প্রভুর স্বাস্থ্য কামনা করে পান করব কিন্তু পরের পাত্র পান করার সময় আপনাকে আমার প্রভু মহামান্য রাজা লুই ত্রয়োদশ স্বাস্থ্য কামনা করে পান করতে হবে।’ শান্তভাবে বলল প্যাথোস। চিৎকার করে আগন্তুক বলল–‘না আমার অন্য কোনো প্রভু থাকতে পারে না। মহামান্য কার্ডিনাল ছাড়া।’ এবং আগন্তুক প্যাথোসের উদ্দেশ্যে তরোয়াল বার করল।
‘বন্ধু প্যাথোস–আশা করি তুমি একাই এই আগন্তুকের মোকাবিলা করতে পারবে। একে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি শিক্ষা দিয়ে আমাদের পথে তুমি ঘোড়া নিয়ে ছুটে এসো।’ এই বলে অ্যাম্বোস বন্ধুদের নিয়ে তাদের গন্তব্যের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে রওনা হলো।
বেশ কিছুক্ষণ ঘোড়া ছুটিয়ে তিনজনে বিউভিস নামক একটা শহরের কাছে উপস্থিত হলো। দূর থেকে তারা দেখল তাদের যে পথ দিয়ে যেতে হবে সেই পথেই আট দশ জন শ্রমিক রাস্তা সারাচ্ছে। কাছে আসতেই তারা বুঝতে পারল লোকগুলো ছদ্মবেশি জার্ডিনাল-এর যোদ্ধা। কোদাল বেলচার বদলে তাদের হাতে এখন বন্দুক ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল সেই অস্ত্রগুলো। অ্যাট্রাগঁন বন্ধুদের হুশিয়ার করে বলল, এরা ছদ্মবেশী যোদ্ধা, মনে রেখো এখন আমাদের লড়াই করার সময় নয় এতে আমাদের আসল কাজের দেরি হয়ে যাবে, ঘোড়া ছোটাও, বন্দুকের গুলির সীমার বাইরে যাও।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এত করে বিপদ এড়ালেও একটা গুলি এসে এ্যারামিসের কাঁধে লাগল। প্রচুর রক্তপাত হতে লাগল এ্যারামিসের কাঁধ থেকে, অবসন্ন হয়ে এলো তার দেহ। ‘আর তো এগুনো যায় না বন্ধু, আমার জন্যে তোমাদের কেন দেরি হবে, তাড়াতাড়ি কোনো সরাইখানায় আমায় পৌঁছে দাও, সুস্থ হলে না হয় আমি তোমাদের সাথে যোগ দেবো।’ এ্যারামিসের স্বরে ক্লান্তি। সারা দেহ ভিজে গেছে ঘামে আর রক্তে।
এ্যারোমিসকে একটা সরাইখানায় বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দুই বন্ধু। অ্যাথোস আর অ্যাট্রাগঁন লন্ডন অভিমুখে চলল।
মাঝরাতে অ্যাথোস এবং অ্যাট্রাগঁন এসে পৌঁছল এ্যামিয়েনস নামে এক জায়গায়। রাতটা সেখানে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন তারা লন্ডন অভিমুখে রওনা হবে। পরিশ্রান্ত দুই যোদ্ধার ঘুম আসতে দেরি হলো না, পরের দিন সকালে সরাইখানার মালিককে অ্যাথোস দু-টো স্বর্ণমুদ্রা দিল। এই যাত্রার জন্য তাদের যে অর্থের প্রয়োজন ছিল তার সবটাই যোগান দিয়েছিলেন মাদাম বোনাসিক্স। সে স্বর্ণমুদ্রা কিছুক্ষণ হাতে নাড়াচাড়া করার পর সরাইখানার মালিক স্বর্ণমুদ্রা দু-টো অ্যাথোসকে ফেরত দিয়ে বলল–‘মঁসিয়ে সকালবেলা মস্করা করা ঠিক উপযুক্ত সময় নয়; আপনার দেয়া দুটো মুদ্ৰাই নকল।’ বিরক্ত অ্যাথোস বলল,–‘তোমার সাথে ঠাট্টা করার সময় আমার নেই আমার সাথে কেউ বিরক্তিকর কথা বললে আমি তার কান দুটো কেটে নেয়াই পছন্দ করি।’ ক্রুব্ধ অ্যাথোস সরাইখানার মালিকের দিকে এগিয়ে গেল। সরাইখানার মালিক অ্যাথোসের সামনে মুদ্রাদুটো এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘মঁসিয়ে উত্তেজিত না হয়ে আমার কথার সত্যতা যাচাই করুন।’
ঠিক সেই সময় চারজন সশস্ত্র লোক দরজা ঠেলে অ্যাম্বোস আর অ্যাট্রাগঁনের দিকে এগিয়ে এলো।
‘অ্যাট্রাগঁন এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করো না, ঘোড়ায় চড়ে তাড়াতাড়ি তোমার উদ্দেশ্যে সাবধানে এগিয়ে যাও। আমার মনে হয় এই চারটে শেয়ালকে ঠাণ্ডা করতে আমার বেশি সময় লাগবে না।’ তরোয়াল নিয়ে ঐ চারজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পড়তে অ্যাম্বোস বলল।
মুহূর্ত মাত্র সময় নষ্ট না করে ঘোড়ায় গিয়ে বসল অ্যাট্রাগঁন। পেছনের পথকে ধুলো ডুবিয়ে তার ঘোড়া তাকে নিয়ে তীব্র বেগে চলে গেল। যখন শহরে পৌঁছতে আর শ-খানের পা বাকি অ্যাট্রাগঁনের ঘোড়া ক্লান্তিতে অবসন্ন। হয়ে রাস্তাতেই বসে পড়ল। ঘোড়া ফেলে রেখে অ্যাট্রাগঁন দৌড়ে ক্যালিস শহরে গিয়ে দেখল বন্দরে সরাসরি জাহাজ বাধা কিন্তু কোনো জাহাজ-ই ছাড়বে না। উপস্থিত কি করা উচিত ভাবতে ভাবতে জাহাজ ঘাটায় হাঁটতে লাগল অ্যাট্রাগঁন। হঠাৎ চোখে পড়ল বুট জুতোয় একরাশ ধুলো মাখা একজন ব্যস্ত ভদ্রলোক একটা জাহাজের ক্যাপটেনের সাথে কথা বলছে। জাহাজের ক্যাপটেন ভদ্রলোকটিকে বলল–‘আমার জাহাজ ইংল্যান্ড যাবার জন্য তৈরিই ছিল কিন্তু আজ সকালে কার্ডিনাল-এর কাছ থেকে নির্দেশ এসেছে তার অনুমতি ছাড়া কোনো জাহাজ ইংল্যান্ড যাবে না।’