এই ঘটনার আট দিন পর কার্ডিনাল রিচিলিউ লন্ডনের ছাপ মারা একটা চিঠি পেলেন, চিঠির বিষয়বস্তু ছিল–
‘আমি সেগুলো হস্তগত করেছি, কিন্তু টাকার অভাবে আমি লন্ডন থেকে ফিরতে পারছি না, আমায় পাঁচশ স্বর্ণ মুদ্রা দ্রুত পাঠান টাকা পাবার চার থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই প্যারিসে পৌঁছে আপনার হাতে সেগুলো পৌঁছে দেব।’
কার্ডিনাল যে দিন এই চিঠিটা পেলেন রাজা সেদিন সৌজন্যবশত কার্ডিনালকে জিজ্ঞেস করলেন–‘মঁসিয়ে কার্ডিনাল ভোজসভার নির্দিষ্ট দিন ঠিক করেছেন কি?’
রিচিলিউ মনে মনে বলতে লাগল—‘মিলেডি লিখেছে টাকা পাবার চার পাঁচ দিনের মধ্যেই প্যারিস পৌঁছবে, লন্ডনে টাকা পৌঁছতেও চার পাঁচ দিন সময় লাগবে। তার মানে হীরের বোতাম নিয়ে তার পৌঁছতে মোট দশ দিন সময় লাগছে। অর্থাৎ বারো দিন আগে রানীর দুর্বলতায় প্রতিকুল আবহাওয়া কি রকম হতে পারে তা বোঝা যাবে না। আহা রানী সকলের সামনে কী রকম হেনস্তা হবে। এবার আর আমি বিফল হচ্ছি না আমার প্রেম প্রত্যাখানের কী চরম পরিণতি।’
রাজা আবার জিজ্ঞেস করলেন–‘মঁসিয়ে কার্ডিনাল আপনি কি দিন ঠিক করেছেন করে আর কোথায় ভোজসভার আয়োজন হবে?
‘হ্যাঁ মহাশয়-আজ ২০ সেপ্টেম্বর। আগামী ৩ অক্টোবর ভোজসভার দিন ঠিক করেছি। এই ভোজসভাতেই আপনি রানীকে আপনার হৃদয়ের গভীর ভালোবাসা জানাতে পারবেন। মহামান্য রাজা একটা কথা আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিই, ভোজের দিন রানী যে হীরের বোতাম লাগানো নেকলেসটা পরেন রানীকে আপনি যেটা তাঁর জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন, আহা রানীকে কী চমৎকারই না সেদিন লাগবে।’
এরপর ভোজের নির্দিষ্ট দিনের কথা জানাতে রাজা লুই ত্রয়োদশ রানীর ঘরে গেলেন, এত দিন রানী শুধু দিন গুনছেন কবে সেই ভোজসভা আসবে, কেন না রানী এ্যান ভোজসভা খুবই পছন্দ করেন। রাজা লুই বললেন হোটেল ডি ভ্যালিতে ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে। মাদাম সেই দিন তুমি উৎসবকে সুন্দর করতে তোমার সবচেয়ে প্রিয় আর দামি পোশাকটা পরবে। আর মনে করে হীরের বোতামওলা নেকলেসটা পরবে যেটা আমি তোমায় তোমার জন্মদিনে দিয়েছিলাম।
‘হ্যাঁ আমি নিশ্চয়ই সেই রকমই সাজবো কিন্তু ভোজসভার দিনটা কবে ঠিক হয়েছে।’ রানী জানতে চাইলেন।
‘কার্ডিনাল রিচিলিউ ৩ অক্টোবর দিন ঠিক করেছে।’ রাজা বললেন। কার্ডিনাল-এর নাম শুনেই রানীর মুখ রক্ত শূন্য হয়ে, হাঁটু থেকে পা কাঁপতে লাগল ভয়ে উত্তেজনায়।
চরম হতাশায় দুঃখে কম্পিত স্বরে রানী জানতে চাইলেন–‘আমি সেই হীরের নেকলেশটা পরি এটাও কি কার্ডিনাল-এর ইচ্ছে?’ রাজা লুই ত্রয়োদশ বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলেন–‘যদি তাই হয় তাতে ক্ষতিটা কি হয়েছে?’
রানী মাথা নেড়ে বললেন–‘না ক্ষতি কিছুই হয়নি।’
‘তাহলে আমি তোমায় যেমন ভাবে সেজে যেতে আদেশ করলাম তুমি। সে ভাবেই ভোজসভায় যাবে।’
‘হ্যাঁ, আপনার নির্দেশ আমি পালন করব।’ কম্পিত স্বরে রানী বললেন। এক সময় রাজা ঘর ছেড়ে চলে যেতে তিনি হতাশায়, ক্লান্তিতে, ভয়ে, উৎকণ্ঠায় কাঁপতে কাঁপতে একটা চেয়ারে বসে পরলেন। ‘হায় আমি শেষ হয়ে গেলাম, আমার আর বাঁচার কোনো রাস্তা রইল না।’ আপন মনে নিজেকে উদ্দেশ্য করে রানী বললেন।
একটা মিষ্টি মধুর মমতায় পরিপূর্ণ স্বর রানীর কানে এলো। মহামান্য রানী আমি আপনাকে কোনো রকমভাবেই সাহায্য করতে পারি না?
‘কে-কে বলছে এই কথা? আমি তো-জানি ঘরে আমি একাই ছিলাম?’ রানী মুখ তুলে সামনের ছোট ঘরটার দিকে তাকালেন, কেন না ওই দিক থেকেই এসেছিল।
‘হ্যাঁ মহামান্য রানী আপনি ঘরে একাই ছিলেন কিন্তু আপনি জানতেন বোধহয় পাশের ছোট ঘরটায় আমি আপনার পোশাক গোছাচ্ছিলাম’ মাদাম বোনাসিক্স কথাগুলো বলতে বলতে রানীর সামনে এসে দাঁড়াল।
‘হায় বোনাসিক্স আমায় আর প্রতারণা কোরো না, আমি তোমাকে কি করে বিশ্বাস করব বলো?’ কাতর স্বরে পাণ্ডুর মুখে রানী বললেন।
‘ওঃ মাদাম! আপনি আমায় বিশ্বাস করুন প্রাণ থাকতে আমি আপনার অবিশ্বাসের কাজ করব না, আপনি আমায় বিশ্বাস করুন রানীমা’ কাঁদতে কাঁদতে মাদাম বোনাসিক্স রানীর পা দুটো জড়িয়ে ধরল। মাদাম বোনাসিক্সের আন্তরিকতায় এতই গভীর ছিল যে, রানী তাকে বিশ্বাস না করে পারলেন না।
‘রানীমা–আপনি আপনার সমস্ত দাসীর মধ্যে আমায়–শুধু মাত্র আমায় বিশ্বাস করতে পারেন,–ভগবানের দোহাই আপনার প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ছাড়া কোনো ছল নেই।’ মাদাম বোনাসিক্স বলে চলল–‘হ্যাঁ রানীমা, আপনার দাসীদের মধ্যেই বিশ্বাসঘাতক আছে, তা না হলে, সেই হীরের বোতামওলা নেকলেসটা যেটা আপনি বাকিংহামের ডিউককে দিয়েছিলেন ভালোবাসার চিহ্ন স্বরূপ-কি রানীমা দেননি? আমি জানি রানীমা আপনি দিয়েছেন। সেই কথা,–সেই গোপন সংবাদ কি করে কার্ডিনাল-এর কানে গেল? আর এ-সব কার্ডিনাল-এর ষড়যন্ত্র। রাজা লুই য়ের কাছে আপনাকে, সমস্ত প্রজার সামনে আপনাকে অশ্রদ্ধা করার এ গভীর ষড়যন্ত্র। ভীত হবেন না রানীমা, ভোজসভার আগেই হীরের নেকলেশটা আপনার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।’
‘কিন্তু কীভাবে বোনাসিক্স?’ উত্তষ্ঠিত রানী জিজ্ঞেস করলেন।
‘একজনকে লন্ডনে পাঠাতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি এখান থেকে একজন ডিউকের কাছে যাবে, বর্তমান পরিস্থিতির কথা জানিয়ে তার কাছ থেকে হারটা নিয়ে আসতে হবে।’ মাদাম বোনাসিক্স মতলব বাতলালেন।