‘মহামান্য আমার মনে হয় ডিউকের প্যারিসে আসা সম্পূর্ণই রাজনৈতিক কারণে,’ কার্ডিনাল রাজার যেন পরম হিতাকাক্ষী হয়ে বলল।
‘না মঁসিয়ে কার্ডিনাল ডিউকের প্যারিস শহরে আসার পেছনে আমার মনে হয় অন্য কোনো কারণ ছিল।’
‘মহামান্য রাজা হয়তো ঠিকই ভাবছেন, না বললে রাজদ্রোহিতা তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলছি, মাদাম ল্যানয় এর কাছ থেকে জেরা করে জানতে পেরেছি গত রাত্রে রানী অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বসেছিলেন এবং আজ সকালে তিনি শুধু কেঁদেছেন আর সারাদিন প্রায় চিঠি লিখেই সময় কাটিয়েছেন।’
চিৎকার করে রাজা বললেন–‘মঁসিয়ে কার্ডিনাল, আপনি ঠিক কথাই বলেছেন আর আমি এখনই ওই চিঠিগুলো হস্তগত করতে চাই।’
দ্রুত পায়ে রাজা রানীর ঘরে এলেন। রানী অ্যানকে তার সখীদের মধ্যে একজন একটা বই পড়ে শোনাচ্ছিল, রাজাকে আসতে দেখে তারা দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল,–‘মাদাম অ্যান তোমার কাছে এখনি আমার একজন প্রতিনিধি (কার্ডিনাল) আসবে, সে তোমাকে আমার নির্দেশ অনুযায়ী কিছু জিজ্ঞাসা করবে। আমি আশা করব তার কোনো কাজেই তুমি বাধা দেবে না।’
দুঃখে রানীর সুন্দর মুখখানা কালো হয়ে গেল, তিনি বললেন ‘মহামান্য রাজা–রাজপ্রতিনিধি আমায় এখন কি কথা বলবে যা আপনি আমায় নিজেই জিজ্ঞেস করতে পারছেন না?’
কোনো উত্তর না দিয়ে রাজা ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবার সাথে সাথেই রাজপ্রতিনিধি রানীর ঘরে ঢুকল–রানীকে অভিবাদন জানানোর পর রাজপ্রতিনিধিকে রানী জিজ্ঞেস করলেন ‘বলুন মঁসিয়ে আপনার কি প্রয়োজন?’
‘মহামান্য রানী, আমি একজন রাজকর্মচারী ছাড়া আর কিছুই নই। রাজ আদেশ পালন করাই আমার কর্তব্য আপনি নিশ্চয়ই এটা অস্বীকার করবেন না, মহামান্য রাজার নির্দেশ আছে আপনার ঘরে আপনার ব্যবহার্য যত কাগজ এবং আপনার লেখা চিঠি আমি তল্লাস করে দেখব, মহামান্য রানী আমার এই কাজের জন্য আমায় ক্ষমা করবেন।’
রাজপ্রতিনিধি রানীর ঘরের সমস্ত ড্রয়ার পরীক্ষা করেও যখন কোনো চিঠিই পেল না তখন রানীকে বলল–‘মহামান্য রানী আপনি আজ যে চিঠিটা লিখেছেন এবং যেটা এখনও পাঠানো হয়নি আমি রাজার নির্দেশে সেই চিঠিটারই তল্লাশ করেছি কিন্তু আপনার সমস্ত ড্রয়ার পরীক্ষা করেও সেটা পাইনি। সেই চিঠিটা যদি আপনার কাছে বা অন্য কোথাও লুকানো থাকে তাহলে রাজার নির্দেশ অনুযায়ী সেটা আমার হাতে দিন। সেটা রাজার কাছে পৌঁছে দেয়াই আমার দায়িত্ব।’
ক্রুব্ধ স্বরে রানী এ্যান বললেন–‘মঁসিয়ে রাজপ্রতিনিধি নিশ্চয়ই রানীকে স্পর্শ করার স্পর্ধা রাখেন না!’
‘সম্মানীয়া রানী, রাজার নির্দেশ আছে আজকের লেখা চিঠিটা আমায় তাঁর কাছে পৌঁছে দিতে হবে, সেই কাজ সমাধানের জন্য আমায় সব কিছুই করতে হতে পারে। আমি রাজভৃত্য ছাড়া আর কিছুই নই, রানী আমায় নিশ্চয়ই ক্ষমা করবেন।’
চিৎকার করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রানী বললেন, ‘অনেক হয়েছে সিয়ে, অনেক হয়েছে, একজন সামান্য রাজকর্মচারীর কাছে আমায় এই অপমানের চেয়ে মৃত্যুও অনেক শ্ৰেয় ছিল!’ বিছানায় অর্ধশায়িত মুচ্ছিত প্রায় রানী এই বলে ‘ডান হাতে একটা চিঠি, যেটা আজ-ই আমি লিখেছি কিন্তু পাঠানো হয়নি, এই সেই চিঠি। যান এটা নিয়ে যান। আর আপনার বিরক্তিকর উপস্থিতি থেকে আমায় নিষ্কৃতি দিন।’
রাজপ্রতিনিধি সম্মানসূচক অভ্যর্থনা জানিয়ে চলে গেল, রানী হতাশায়, ক্রোধে, অপমানে, কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
রাজপ্রতিনিধি চিঠিটা নিয়ে রাজা লুইয়ের হাতে দিল। রাজা লুই চিঠিটা খুলে পাঠ করলেন–চিঠির ঠিকানা ছিল স্পেনের রাজার উদ্দেশ্যে। স্পেনের রাজা রানী এ্যানের আপন দাদা। আর চিঠির বিষয় বস্তু ছিল খুবই সাধারণ, তার দাদাকে রানী চিঠিতে জানিয়েছিল যে ফ্রান্স কার্ডিনাল-এর শাসন থেকে মুক্ত। বাকিংহামের সাথে তাঁর প্রণয়ের কোনো কথাই চিঠিতে লেখা ছিল না।
চিঠি পড়ে রাজা খুব আনন্দিত হলেন। খোঁজ নিয়ে জানলেন যে কার্ডিনাল এখনো লুভেতেই আছে। রাজা আদেশ দিলেন কার্ডিনাল যেন আমার গোপন ঘরে অপেক্ষা করে।
গোপন ঘরে রাজা এসে চিঠির কথা কার্ডিনালকে জানিয়ে বললেন ‘মঁসিয়ে কার্ডিনাল আপনিই ঠিক বলেছেন। ডিউকের প্যারিসে আসা সম্পূর্ণই রাজনৈতিক, অন্য কিছু নয়। রানী এ্যানের প্রতি সন্দেহের কোনো কারণ নেই। তিনি আমায় যথেষ্ট ভালোবাসেন বরং আমার খারাপ লাগছে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে তাঁকে আমি অপমানই করলাম।’ খুব দুঃখের সাথে শেষের কথাগুলো রাজা বললেন। কার্ডিনাল রাজা লুই ত্রয়োদশকে অভিবাদন জানাল।
ঘড়িতে রাত এগারোটার ঘণ্টা ধ্বনিত হলো। রাজাকে অভিবাদন জানিয়ে কার্ডিনাল বিদায়ের জন্য উঠে দাঁড়াল আর বলল ‘মহামান্য রাজা আপনার বিশ্রামের জন্য আমায় বিদায় নেবার অনুমতি দিন, আর মহামান্য রাজা আজকের ঘটনায় আমাদের রানী নিশ্চয়ই খুব আঘাত পেয়েছেন, আপনি আমাদের প্রিয় রানীকে আপনার ভালোবাসা এবং সুন্তর ব্যবহার জানিয়ে তাকে এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা থেকে শান্তি দিন। এ-ছাড়া আমি আপনাকে রানীর আনন্দের জন্য পরামর্শ দিই শীঘ্রই একটা ভোজসভা ডাকুন আমাদের রানী ভোজসভা খুবই পছন্দ করেন।’
পরদিন রাজার ব্যবহারে রানী খুবই আশ্চর্য হয়ে গেলেন, রানী আশা করেছিলেন যে ওই চিঠিটার জন্য রাজা নিশ্চয়ই তাকে তিরষ্কার করবেন, কিন্তু একি! তার পরিবর্তে রাজা রানীর সাথে এত সুন্দর আবেগপূর্ণ ব্যবহার করছেন কেন? রাজা যখন বুঝতে পারলেন রানী এ্যানের আর রাগ নেই সেসময় রানীকে আশ্চর্য করে দিয়ে বললেন যে, তিনি শীঘ্রই একটা ভোজসভার আয়োজন করছেন।