.
রাজা, রানীমা ও মহামন্ত্রী ম্যাজারিন থাকেন প্যালেই–রয়েল নামক নামের প্রাসাদে, আগের দিনের স্যুভর প্রাসাদ এখন বাতিল বললেই হয়। সেখানের উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা রানী হেলরিয়েটা।
এই রানী হেলরিয়েটা ইংল্যান্ডের রাজা চার্লসের স্ত্রী, ফ্রান্সের রাজকন্যা। বর্তমান রাজার দাদা (পিতামহ) যে চতুর্থ হেনরি, তারই কন্যা। ইংল্যান্ডে প্রজা বিদ্রোহ চলেছে ভয়ানক ভাবে। যুদ্ধে রাজা চার্লস পরাজিত হয়েছেন প্রজাদের হাতে নিরাপত্তার জন্য রানীকে এবং বেশির ভাগ ছেলে মেয়েদের পাঠিয়ে দিয়েছেন বিদেশে। প্রথম পুত্র গিয়েছে হল্যান্ডে। রানী একটি কন্যাকে নিয়ে এসেছেন বাপের বাড়ি ফ্রান্সে।
এখানে তিনি আশ্রয় পেয়েছেন, আর কিছু পাননি, কৃপন ম্যাজারিন রাজা লুইকে ঘেঁড়া বিছানায় শুতে বাধ্য করেন, আর তিনি অন্য দেশের রানী, নিজ দেশ থেকে নির্বাসিত রানীর আরামের কী ব্যবস্থা করবেন? অতিকষ্টেই কাটে হেলরিয়েটার, শীতকালে ঘরে আগুন জ্বালাবার টাকা জোটে না তার। সারাদিন বিছানাতেই শুয়ে ঠাণ্ডার হাত থেকে আত্মরক্ষার কারণ। একটি চাকরও নেই। বাইরের লোক এলে রাজকুমারীকেই গিয়ে দরজা খুলে দিতে হয়।
এমনি সময় ইংল্যান্ড থেকে দূত এল তার কাছে দ্রুত। আর কেউ নয় লর্ড উইন্টার। রাজা চার্লসকে ইংল্যান্ডের সমস্ত লর্ডেরাই ত্যাগ করেছেন, ত্যাগ করেননি শুধু উইন্টার। আজ তিনি চালর্সের চিঠি নিয়ে এসেছেন হেনরিয়েটার কাছে, একটি অতি প্রয়োজনীয় চিঠি।
রাজা চালর্স এই চিঠিতে জানতে চেয়েছেন, শেষ যুদ্ধে যদি তিনি ক্রমওয়েলের (অতি সাধারণ ঘরে জন্ম, কিন্তু প্রজা বিদ্রোহের ইনিই ছিলেন নেতা, চার্লসকে পরাজিত ও নিহত করার পর ইনিই ইংল্যান্ডের শাসক হন) হাতে পরাজিত হন, ফ্রান্স কি তাকে আশ্রয় দেবে?
রানী হেনরিয়েটা এ প্রশ্নের জবাব দেবেন কেমন করে? তাকে তাহলে ম্যাজারিনের কাছে যেতে হবে।
ম্যাজারিনের কাছে? লর্ড উইন্টারের ভালো লাগে না এ কথা। যেতে যদি হয়ই রানী হেনরিয়েটার যাওয়া উচিত রানী অ্যানের কাছে, উনিও রানী, উনিও রানী, তার উপর দুই রানীর ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, অ্যানের কাছে গিয়ে যদি ব্যর্থ হয়ে ফিরতেও হয় তবু তাতে অপমান নেই। কিন্তু ম্যাজারিন? সেদিন পর্যন্ত যে এক ফরাসি যাজকের চাকর ছিল, তার কাছে ইংল্যান্ডের রানীর যাওয়া উচিত নয়। আর গেলেও আবেদন সফল হওয়ার নিশ্চয়তা কি? ইতালী কি বুঝবে? কিন্তু হেনরিয়েটা জেদ করে ম্যাজারিনের কাছেই গেলেন।
ক্রমওয়েলও চিঠি লিখেছেন ফ্রান্সে, তার দূত একটু আগেই চিঠি এনে দিয়েছে ম্যাজারিনের হাতে, সে দূত আর কেউ নয় হত্যাকারী মর্ডন্ট হেনরিয়েটা আসছেন সংবাদ পেয়েই ম্যাজারিন পিছনের সিঁড়ি দিয়ে মর্ডন্টকে প্রাসাদ থেকে বার করে দিয়েছেন। হেনরিয়েটা ঢুকেছেন সামনের দরজা দিয়ে, মর্ডন্ট বেরুচ্ছে গুপ্তদ্বার দিয়ে।
শেষ পর্যন্ত হেনরিয়েটাকে খালি হাতেই ফিরতে হলো, ম্যাজারিনকে তিনি কোনো মতেই রাজী করাতে পারলেন না, পরাজিত রাজা চার্লস যদি ইংল্যান্ড থেকে পালাতে পারেন, ফ্রান্সে তার ঠাই হবে না, তাকে আশ্রয় নিতে হবে স্পেন বা হল্যান্ডে। কারণ? আছে বই কি? অন্য দেশের যুদ্ধে নাক গলাতে ইচ্ছুক নন ম্যাজারিন। নিজের অশান্তিরই শেষ নেই তার, এখানেও প্রজারা বিদ্রোহী হয়েই আছে বলা যায়। ক্রমওয়েল যদি উসকানি দেন চ্যানেলের ওপার থেকে, এখানেও রক্তনদী বয়ে যাবে দেখতে দেখতে, না ক্রমওয়েলকে শত্রু করতে পারেন না ম্যাজারিন। মহান চতুর্থ হেনরি কন্যার জন্যও না।
হেনরিয়েটার মুখে খবর শুনে বড়ই মুষড়ে পড়লেন লর্ড উইন্টার। কোনো আশ্বাস না নিয়েই তিনি চার্লসের কাছে ফিরে যাবেন?
না, তা কিছুতেই হবে না, ফরাসি রাজশক্তির কাছে সাহায্য না পান, ফরাসি জনসাধারণের সাহায্য পাওয়ার একটা চেষ্টা তাকে করতেই হবে। কিন্তু জনগণ এখন নিজেদের সমস্যা নিয়েই ব্যস্ত। ম্যাজারিনের শোষণ ও কুশাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় খুঁজছে যারা রাজপক্ষ তাদের ব্যঙ্গ করে ‘ফ্রন্ডি’ নাম দিয়েছে। ফ্রন্ডি বলতে সেই সব নিষ্কর্মা রাস্তার ছেলেদের বুঝায় যারা ঢিল মেরে ব্যাঙ মারে রাস্তার নর্দমায়, আর পুলিশ দেখলেই ছুটে পালায়, রাজার দল ব্যঙ্গ করে ফ্রন্ডি নাম দিয়েছে তাদের, তারা সে নাম গৌরবে মাথায় তুলে নিয়েছে। ফ্রন্ডির ভয়ে ম্যাজারিন এখন তটস্থ।
তাহলে রাজা প্রজা কোনো দিকই থেকেই কোনো সাহায্যের আশা নেই। না, আছে। হঠাৎ উইন্টারের মনে পড়ে গেল বিশ বছর আগের কথা দ্যার্তেগা, অ্যাথোস, পোর্থস আর অ্যারামিসের কথা সেই অদ্ভুত করিতকর্মা সৈনিক চারজন এখন কোথায়? তাদের যদি সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, রাজা চার্লসের বন্ধুহীন অবস্থার কথা বুঝিয়ে হেনরিয়েটা যদি সেই উদারচেতা বীর পুরুষদের অনুকম্পা জাগিয়ে তুলতে পারেন, তাহলে ওই চারটি তরবারি অন্তত ইংল্যান্ডের রাজার সেবায় আন্তরিকভাবেই নিয়োজিত হবে এবং পূর্ব অভিজ্ঞা থেকে উইন্টার ভালই জানেন যে পুরো একটি সৈন্যবাহিনীর চাইতে ওই চারজন সৈনিকের অনুগত্যের মূল্য অনেক বেশি।
চেষ্টা থাকলে উপায় হয়ই, অপ্রত্যাশিতভাবে কাউন্ট দ্য ল ফেয়ারের ঠিকানা পেয়ে গেলেন উইন্টার। রানী হেনরিয়েটার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল রাওল, তার মুখ থেকেই, সেদিনই উইন্টার সাক্ষাৎ করলেন কাউন্টের। অর্থাৎ অ্যাথোসের হোটেলে গিয়ে, তাকে এবং অ্যারামিসকে নিয়ে এলেন রানীর বাসস্থানে।