‘ছিল একজন।’ বলতে গিয়ে গ্রিমড যেন শিউরে ওঠে–‘একজন ছিল তার দারুণ শত্রু। মিল্যাডি।’
সে নাম শুনে শিউরে উঠলেও মুখে সবাই একটা তাচ্ছিল্যের শব্দ করল—’মিল্যাডি মারা গিয়েছে কবে।’
‘কিন্তু মিল্যাডির ছেলে বেঁচে আছে।’ নিয়তির মতো নির্মম শোনায় গ্রিমডের কথা।
‘ছেলে? মিল্যাডির ছেলে ছিল নাকি?’ ভূতে পাওয়া লোকের মতো দেখায় চার বন্ধুকে।
‘ছিল তো বটেই। সে এখন বাইশ বছরের যুবক, মায়ের হত্যার বদলা নিতে সে ফ্রান্সে এসে হানা দিয়েছে, তার প্রথম শিকার ওই বেথুনের ঘাতক।’
‘লোকটার–ছেলেটার নাম কী?’
‘বেথুনের ঘাতক বলেছিল মর্ডন্ট ওই ছেলেটার নাম।’
‘ওই মর্ডন্ট রাওলের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়নি তো?’
‘হয়েছে বইকি, তা নইলে আর নিয়তির খেলা বলছিলেন ব্যাপারটাকে?’ ভাইকাউন্ট রাওলই যাজকবেশী মর্ডন্টকে পৌঁছে দেন আহত ঘাতকের শেষ শয্যার কাছে।
অ্যাথোস কপাল চাপড়ে বললেন ‘সত্যিই নিয়তি’।
এবার গ্রিমডও সমস্ত কাহিনী খুলে বলল। সেটা এরকম :
গ্ৰেনির সরাইখানায় খেতে খেতে পরপর দুটো আর্তনাদ শুনতে পায় গ্রিমড। খাওয়া ফেলে সে ছুটে যায় স্বর লক্ষ্য করে। কাতরানি শোনা যাচ্ছিল একটা ঘরের ভেতর থেকে। তার দরজা বন্ধ। দরজা ভেঙে সে দেখতে পেল একটা লোক বিছানায় পড়ে আছে। তার বুকে একটা ছোরা গাঁথা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে বিছানা।
আহত লোকটিকে দেখেই চিনল সে, লোকটি সেই বিশ বছর আগের দেখা বেথুনের ঘাতক।
একটা অস্ফুট শব্দ বের হয় চার বন্ধুর মুখ থেকে। ভয় আর বিস্ময়ের মিশ্রণ সেই আওয়াজে।
গ্রিমড বলে চলে তার গল্প।
বেথুনের ঘাতক তখনো মারা যায়নি। অতি কষ্টে তার মুখ থেকে কাহিনীটি শুনেছে গ্রিমড। যাজককে আনা হয়েছিল শেষ স্বীকারোক্তি শোনাবার জন্য। সেই কারণে আত্মপরিচয় দিতে হয় তাকে। পরিচয় শুনেই হলদে মুখ লাল হয়ে যায় যাজকের।
প্রশ্ন করে বিশ বছর আগের সেই দুযযার্গের রাতেও বীভৎস কাহিনী সে। সবই শুনে নিল, মিল্যাডির বিচার ও মাথা কাটার কাহিনী। প্রশ্নের ভঙ্গী থেকে ঘাতকের মনে হয়েছিল এ কাহিনীর কিছু অংশ তার আগে থেকেই জানা।
মিল্যাডির কথা বলতে বলতে একসময় ঘাতক উল্লেখ করে মিল্যাডির আগের নাম ছিল অ্যান নই। ব্যস, এই নামটি শুনেই যাজকের চেহারা পাগলের মতো হয়ে গেল। ‘তুমি অ্যান ব্রুনইকে হত্যা করেছিলে?’ বলেই ছুটে এসে ছোরা বসিয়ে দিল ঘাতকের বুকে, তারপর ‘আমি অ্যান ব্রুইনের পুত্র’ এই কথাটি ঘাতকের নাকের কাছে মুখ এনে বলল। সে তো মানুষের কথা নয়, যেন সাপের হিসহিসানি। ওটাই ছিল যাজকের শেষ কথা। তারপর সে জানালা খুলে পিছন দিক দিয়ে লাফিয়ে পড়ল বাইরে।
শেষে গ্রিমড জানাল–সরাইওলা অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যাজক বা তার গাধার সন্ধান পায়নি।
‘কিন্তু সে কোথায় গিয়েছে, তা আমি জানি?’–জোর দিয়ে বলে উঠে গ্রিমড–‘সে এসেছে এই প্যারিসে। শত্রু তার ছয়জন, ছয়জনের মধ্যে একজন গেল–বাকি আরও পাঁচ। পাঁচের চারজন আপনারা আর একজন বোধহয়—’
‘লর্ড উইন্টার’ কথা যুগিয়ে দেয় অ্যাথোস।
‘নিশ্চয়, গ্রিমড বলে জানি না তিনি এখনও বেঁচে আছেন কি না। কিন্তু আপনারা জীবিত। মিল্যাডির ছেলে এখন ছোরা শানাচ্ছে আপনাদের রক্তপাতের জন্য। আপনারা সতর্ক হোন, সে হয়তো খুঁজছে আপনাদের। হয়তো এই মুহূর্তে রাজপথ থেকে এই ঘরের জানালার দিকে লক্ষ্য রেখেছে সে।’
অ্যারামিস তাড়াতাড়ি জানালার পর্দা টেনে দিল, পোর্থস বুকের উপর আঁকল ক্রশের চিহ্ন।
কিন্তু দ্যার্তেগা হাসল–‘আমরা কি চারটা জোয়ান বীর পুরুষ, না দাঁত হীন বুড়ী? একটা মাত্র বালক তা সে যত শক্তিশালী দুবৃত্তই হোক, আমাদের পিছু নিয়েছে বলে আমরা ভয়ে কুঁকড়ে থাকব?’
অ্যাথোস ধীরে ধীরে গম্ভীর স্বরে জবাব দিল–‘না আমরা থাকব না, যে অবস্থাতেই পড়ি, বীরের যোগ্য আচরণ আমরা করব বই কি! তবে এটা ঠিক যে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। ওই একটিমাত্র বালকই আমাদের চারজন বীরপুরুষের সঙ্গে সমানে-সমানে মোকাবিলা করার শক্তি রাখে।’
‘বলো কি। এমন মানুষ দুনিয়ায় আছে বলে বিশ্বাস করি না, বলে ওঠে দ্যার্তেগা।
‘ও মানুষ নয় বন্ধু, ও মানুষ রুপের পিশাচ।
অ্যাথোসের ভাগ্য ভালো, তার সমস্ত দুঃখ ঘুচিয়ে দেয়ার জন্য রাওল হঠাৎ এসে পড়ল। সুসংবাদ নিয়ে এসেছে সে, রাজা ও রানীমার কাছে সুসংবাদের বাহক হয়ে এসেছে। প্রিন্স কন্ডির সুনজরে সে পড়ে গিয়েছে এর মধ্যে। তাই কন্ডি তাকেই বেছে নিয়েছেন যুদ্ধ জয়ের খবর রাজধানীতে পৌঁছে দেয়ার জন্যে। লেনস এর যুদ্ধে স্পেনীয় বাহিনীকে শেষ করেছেন কন্ডি। ফরাসি সীমান্ত থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন শত্রুকে।
রাওল রাজ সভা থেকে এসেই অ্যাথোসের সঙ্গে দেখা করল এবং রাত্রিটা তার কাছে কাটিয়ে সকাল বেলাতেই রওনা হয়ে গেল ব্রাগোলেন দুর্গের দিকে, ব্লয় নগরীর কাছেই ব্রাগোলন অ্যাথোসের বাড়ি। সেখানকার বন্ধু বান্ধবীদের জন্য রাওল খুব উৎকণ্ঠা বোধ করছে।
অ্যাথোস দুঃখ পেল একটু। সংসারে রাওল ছাড়া আর তার অন্য কোনো অবলম্বন নেই, সে এখনও সংসারে রয়েছে, সে শুধু এই রাওলের মুখ চেয়ে। সেই রাওল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এসে এক রাতের বেশি অ্যাথোসের কাছে থাকতে পারছে না, সংসার এমনই বিচিত্র জায়গা।
কিন্তু অ্যাথোসের এ দুঃখ অল্প সময়ের জন্য। পরের দিনই সে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিল যে রাওল সেই মুহূর্তে তার কাছে ছিল না, কিন্তু সে কথায় পরে আসছি।