‘আলোচনা, না যুদ্ধ’ দ্যার্তেগা বাকা হাসি হেসে জিজ্ঞেস করে পোর্থর্সকে। বিশ্বাস ভেঙে গিয়েছে, এখন বিশ্বাসঘাতকতা।
পোৰ্থস সাদাসিধে, সে বলে–‘যুদ্ধ হয়–হতে কতক্ষণ? হোক, আমরা তাতে পিছপা নই, কারণ ওরা পঞ্চাশ জন ছিল, আজ আমরাও দুজন, ওরাও দুজন। দেখে নেব।’
রাত নটাতেই ওরা প্রস্তুত হয়ে রওনা হল, লম্বা আলখেল্লার নিচে লুকিয়ে রাখল লম্বা তরোয়াল, প্রস্তুত থাকা ভালো, কি জানি যদি যুদ্ধই করতে হয়।
অ্যাথোস আর অ্যারামিসও দেরি করল না। অস্ত্র নিয়ে তারাও এসেছে। অ্যাথোস অবশ্য আসতে চায়নি, আসতে বাধ্য হয়েছে অ্যারামিসের জন্য। অ্যারামিস বিশ্বাস করে না এদেরকে, বিশেষ করে দ্যার্তেগাকে। পার্কের গেট তালা বন্ধ, চাবি থাকে রোহান হোটেলে, অ্যারামিস সবাইকে চেনে, সে গিয়ে চাবি নিয়ে এল সেখান থেকে, চারজন গিয়ে বসল এক গাছের নিচে, অন্ধকারে।
অভিযোগ, অনুযোগ, অসন্তোষ, আক্ষেপ, রাগারাগি থেকে ক্রমশ আক্রমণের পর্যায়ে। বসেছিল, উঠে দাঁড়িয়েছে সবাই, ক্রোধে, উত্তেজনায় আলখেল্লার নিচে তরোয়ালের বাট ধরেছে শক্ত করে।
একই নালিশ উভয় পক্ষের মুখে–সরলতার অভাব তোমাদের, আগে কেন বললে না যে তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছ। এ ঠিক যেন পিছন থেকে ছুরি মারা।
অবশেষে সমস্ত ঝগড়ার উপর শান্তিজল ছিটিয়ে দিল অ্যাথোস। নিজের তরোয়াল হাঁটুর চাপে দুই টুকরো করে ভেঙে ফেলে দিল বুক চিতিয়ে দাঁড়াল দ্যার্তেগার সামনে–‘ইচ্ছে হয় তোমার তরোয়াল বসিয়ে দাও আমার বুকে, আমি কখনও বন্ধুকে আঘাত করতে পারব না।’
এ মহৎ দৃষ্টান্ত কি অন্তর স্পর্শ না করে পারে? যারা অস্ত্র কোষ মুক্ত করেছিল, তারা কোষবদ্ধ করল আবার, আগের দিনের সাহচর্যের মধুর স্মৃতি তাদের হৃদয় করে তুলল সিক্ত, আপ্লুত পোৰ্থস আর অ্যারামিস পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল বুকে, দ্যার্তেগা অ্যাথোসের বুকের উপর পড়ে চোখের জল ফেলতে লাগল।
তারপর সবাই একটু শান্ত হলে নতুন করে আলোচনা শুরু হলো আবার, এবার আলোচনায় অতীত নেই, আছে ভবিষ্যৎ একটা নীতি স্থির করতে হবে, একটা কর্মসূচী চাই।
অ্যাথোস বলল–‘বোফোর্টও আমার কেউ নয়, দ্যার্তেগারও কেউ নয় ম্যাজারিন, সাময়িক প্রয়োজনে আমরা যে যার দলে যোগ দেই না কেন, আসলে আমরা চারজনে এক দল, যে দল চিরদিন এক থাকবে বলে আমার বিশ্বাস। বিরোধী দলে আমরা কাজ করতে পারি, কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে বিরোধ আমরা প্রাণ গেলেও করব না, যুদ্ধ ক্ষেত্রে, শত্রু শিবিরে যখন যেখানে আমাদের সাক্ষাৎ হবে, আমরা যেন সেখানেই পরস্পরের সংকটকে নিজের বলে গ্রহণ করতে পারি। যে কোনো প্রয়োজনে চারবন্ধু যেন একান্ন হয়ে চেষ্টা করতে পারি। ঠিক সেই বিশ বছর আগের মতো।’
এই শপথকে হৃদয় দিয়ে মেনে নিল চারবন্ধু, তাদের নীতি হল, বীরে সমাজে বন্ধুত্বের আদর্শ স্থাপন। একের জন্য চার। চারের জন্য এক।
রাত্রি অনেক হয়েছে। আজকের মতো আলোচনা শেষ করতে হয়, কিন্তু কাল আবার মিলিত হবে। ভাঙা হৃদয় জোড়া লাগার এ আনন্দকে এত সহজে ছেড়ে দেয়া যায় না। ঠিক হলো একটা নির্দিষ্ট হোটেলে পরদিন সন্ধ্যা বেলা চার বন্ধু আবার এক হবে এবং রাতের খাবার খাবে।
অ্যাথোস জানে, খাবার টেবিলে মনের উদারতা বেড়ে যায়, হৃদয় হয় নরম। অতীতের অনেক ভুলই শ্যাম্পেনের গ্লাসে ডুবে যায়।
.
পরের দিন সন্ধ্যায় খাবারের টেবিলে বিশ বছর আগের সুবাতাস বইছে, পোর্থসের হাসিতে ভরে উঠছে সারা হোটেল। অ্যারামিস আর দ্যার্তেগা পরস্পরকে হানছে রসিকতার তীক্ষ্ণ ছুরি, সাথে অ্যাথোস বড় ভাই সুলভ হাসিতে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে তিনজনকে।
হঠাৎ অপ্রতাশিত ভাবেই সেখানে ঢুকল গ্রিমড। অ্যাথোস চমকে উঠল। তবে কি কোনো বিপদ ঘটল প্রিয় রাওলের? কী সর্বনাশ! রাওল যে একমাত্র অবলম্বন অ্যাথোসের জীবনে। ঈশ্বর কী কেড়ে নেবেন সেই সম্বলকে।
কিন্তু অ্যাথোসের সুস্পষ্ট আদেশ ছিল গ্রিমড রাওলের সঙ্গে থাকবে যুদ্ধক্ষেত্রে। গুরুতর কারণ না ঘটলে গ্রিমড অ্যাথোসের সামান্য আদেশ ফেলত না।
‘রাওল বেঁচে আছে তো’ সরাসরি প্রশ্ন করে অ্যাথোস।
‘না, না, ভাইকাউন্টের কিছু হয়নি মালিক, সামান্য বিপদও নয়, সে জন্য আপনি ভাববেন না।’
‘ওঃ বড় ভাবিয়ে তুলেছিল, যাক রাওল যখন বেঁচে আছে, তখন কোনো কিছুতেই আমি বিচলিত হব না।’
‘কিন্তু এমন খবর এনেছি, যাতে মলিক নিশ্চয়ই বিচলিত হবেন বলে আমার বিশ্বাস। বেথুনের সেই ঘাতক। তাকে মনে আছে? মালিক অথবা মালিকের মাননীয় বন্ধুগণের?’
বেথুনের ঘাতক! অ্যাথোসের ঠিকই মনে আছে, মনে আছে দ্যাগো, পোর্থস ও অ্যারামিসেরও। সে সেই নারীপিচাশী সিন্যাকির মাথা কেটে ছিল লয়ার নদীর পাড়ে বিশ বছর আগের এক অন্ধকার রাতে। হ্যাঁ মরে আছে বই কি। সে ঘটনা ভুলার নয়।
অ্যাথোস উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে–‘কী হয়েছে সেই বেথুনের ঘাতকের?’
‘সে মারা গেছে কাল রাত্রে।’
‘তাই? মরে থাকলে তো ভালই হয়েছে, বিবেকের দংশনের হাত থেকে বেচেছে লোকটা। তুমি জানলে কী করে? প্রশ্নটা অবান্তর বলে মনে হয়।’
‘বেথুনের কাছাকাছিই তো যুদ্ধ হচ্ছে।’
‘তা সত্য, কিন্তু কীভাবে মারা গেল বেথুনের ঘাতক?’
‘আততায়ীর ছোরার আঘাতে।
আবার একটা চমক খেল সবাই, ঘাতককে কে করবে ছোরার আঘাত? তার কে এমন শত্রু থাকতে পারে?