এবার যাজক চোখ তুলে তাকাল। দুই চোখের দৃষ্টি যেন ছুরি হয়ে ঢুকে যায় একবারে মনের মধ্যে।
‘আমি যাচ্ছি’ আস্তে উত্তর দেয় সে।
রাওলই তাকে বুঝিয়ে বলে–‘সরাইখানায় গেলেই আহত লোকটিকে পাবেন। আঘাত খুবই সাংঘাতিক তার। ডাক্তার যদি পাওয়া যায়ও তাহলেও কোনো উপকার হবে না। উপকার যদি হয়, আপনার দ্বারাই হবে, আপনি এগিয়ে যান, আমরা আপনার সঙ্গে যেতে পারছি না। কারণ আমাদের তাড়া আছে। ঠিক উল্টো দিকে যাচ্ছি আমরা।’
গিচেও তার কথা বলে–‘আমরা অন্যদিকে যাচ্ছি সত্যি, কিন্তু এই পথেই ফিরব। তখন যদি শুনতে পাই যে আপনি যাননি বা কর্তব্যে অবহেলা করেছেন, তা হলে আপনি যেখানেই থাকুন, আপনাকে খুঁজে বার করে সে অবহেলার সাজা দেয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে। তা জেনে রাখুন।’
আবার সেই ছুরি ঝলসে উঠল যাজকের চোখে। কিন্তু চোখ নামিয়ে সে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলল–‘আমি তো যাচ্ছিই।’
তারপর যাজক তার খচ্চর চালাল গ্রামের দিকে, আর গিচে রাওলও ঘোড়া ছোটাল ক্যাম্বিন শিবিরের দিকে, কন্ডি সেখানে আছেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে যদি তার কাছে হাজির না হওয়া যায়, এত তাড়াতাড়ি করে ছুটে আসা একান্তই বৃথা যাবে।
যাজক এসে যখন সরাইখানায় পৌঁছাল, আহত লোকটি তখন ঘরের ভেতরে। একটু আগেই গিচের শিক্ষক তাকে এখানে এনে তুলেছেন।
মুমূর্ষকে যখন ঘরে ঢোকানো হচ্ছে, সরাইওয়ালা আর তার স্ত্রী তখন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুজনেই তাকিয়ে ছিল ওর মুখের দিকে এবং কি আশ্চর্য! দুজনে একই সঙ্গে চমকে, শিউরে উঠেছিল।
সরাইওয়ালা তার স্ত্রীকে বলল, ‘চিনতে পারলে?’
‘পারিনি আবার! আমাদের ভাগ্যে যে কি আছে, কে জানে।’ স্ত্রী কপালে আঘাত করে বলল–‘ভাগ্যে আছে ঘোরতর বিপদ, তা নইলে বেথুনের ঘাতক আমাদের ঘরে এসে উঠবে কেন?’ ঠিক সেই মুহূর্তে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই যাজক ‘বেথুন ঘাতক’ কথাটি তার কানে প্রবেশ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষটা যেন পাথরের মূর্তিতে পরিণত হয়ে গেল।
.
প্রায় আধঘণ্টা পরে। গিচের শিক্ষক চাকরদের নিয়ে সরাই থেকে চলে গিয়েছে, গিচের সাথে যোগ দিতে হবে তাকে।
এদিকে যাজক ঢুকেছে মুমূর্ষের রুমে, সে রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ কারণ মৃত্যুপথযাত্রী যখন যাজককের কাছে পাপ স্বীকার করে যাজক ভিন্ন অন্য কারো তা শোনা নিষেধ।
‘হ্যাঁ, আধঘণ্টা কেটে গিয়েছে, নতুন একজন পথচারী এসে সরাইতে ঢুকল, এ মিড, যার জন্য রাওল সারা পথে হোটেলে ঠিকানা রেখে যাচ্ছে।’
গ্রিমড এসেই জিজ্ঞেস করল—’এ পথে ষোলো বছর বয়স্ক কোনো তরুণ যোদ্ধা গিয়েছে কি?’
সরাইওয়ালা বলে উঠল–‘গিয়েছে বইকি? মাত্র আধঘণ্টা আগে তিনি এখানেই ছিলেন, ভাইকাউন্ট ব্যাগোলন? তিনি আজ রাতে ক্যাম্বিনে থাকবেন। সেখানে গিয়েই ধরতে পারবেন তাকে।’
যাক নিশ্চিন্তা গ্রিমড হাফ ছেড়ে একটা চেয়ারে বসে পড়ল। কিছু খাবার আনার জন্য বলল সরাইওয়ালাকে।
খাবার আসতে দেরি হলো না, গ্রিমড খেতে শুরু করেছে–
এমন সময় একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ।
সবাই চমকে উঠল! কার আর্তনাদ! কোথা থেকে?
ভেতরের ঘর থেকে, সেখানে আছে ওই আহত ব্যক্তি আর যাজক।
কে সেই আহত, গ্রিমড উদ্বিগ্ন জিজ্ঞাসার উত্তরে সবে বলতে শুরু করেছে সরাইওয়ালাও, এমন সময়ে আবার আবার একটা আর্তচিৎকার, এবার আর তত তীক্ষ্ণ চিৎকার নয়, অনেকটা যেন কাতরানির মতো।
গ্রিমড আর নির্লিপ্ত থাকতে পারল না, ছুটল আর্তনাদ লক্ষ্য করে, ছুটল সরাইওয়ালাও। আহতের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, এদিক থেকে সজোরে, ধাক্কা দিল গ্রিমড। কেউ দরজা খোলে না, কোনো সাড়াও দেয় না, কিন্তু কাতর আর্তনাদ সমানভাবে শোনা যাচ্ছে, না সমানভাবে নয়, স্বরটা যেন ক্রমশই নিস্তেজ হয়ে আসছে।
‘দরজা ভাঙতে হবে,’ বলে গ্রিমড।
সরাইওয়ালা সায় দিলে, দরজা ভাঙতেই এক বীভৎস দৃশ্য দেখে দুজনেই পিছিয়ে আসতে বাধ্য হল। বিছানার উপর সেই আহত লোকটি পড়ে আছে, তার বুকে একটি লম্বা ছোরা, ঘর ভেসে যাচ্ছে রক্তের স্রোতে।
মুহূর্তে ভয় এবং আতঙ্ক ঝেড়ে ফেলে দিয়ে গ্রিমড এগিয়ে গেল ঘরের ভেতর, এ লোকটাকে ছোরা মারল কে? শুধুমাত্র যাজক ছিল এই ঘরে, সে কোথায় গেল? কোথাও নেই সে, জানালা অবশ্য ভোলা রয়েছে। ওই পথ দিয়ে পালিয়ে গেছে সে।
সরাইওয়ালা ছুটে বেরিয়ে গেল, যাজককে ধরার জন্য এবং ডাক্তারকে ডাকার জন্যও। গ্রিমড গিয়ে ঝুঁকে পড়ল বিছানার উপর। লোকটা এখানো মরেনি।
মরেনি এবং তাকে দেখেই গ্রিমড আবার এক পা পিছিয়ে এল ভয়ে, বিস্ময়ে তার মুখ থকে বেরিয়ে এল একটা অর্ধস্ফুট শব্দ–‘বেথুনের সেই ঘাতক!’
.
৩.
মনে ব্যথা নিয়ে ফিরে এসেছে দ্যার্তেগা আর পোর্থস, অ্যাথোস আর অ্যারামিস ছিল অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। তারা আজ শত্রুপক্ষে।
আজ যারা শত্রুপক্ষে, কাল তারা শত্রু হয়ে দাঁড়াতে কতক্ষণ? আজ বোফোর্টের জন্য যারা তরোয়াল তুলেছে দ্যার্তেগা-পোর্থসের মাথার উপর, কাল যে তারা নিজেদের স্বার্থের খাতিরে সেই তরোয়াল তুলবে না, সেই নিশ্চয়তা কোথায়?
কিন্তু বিদায়ের সময় অ্যাথোস বলে দিয়েছে–প্যারিসে এসে তারা এ সম্বন্ধে আলোচনা করবে। আজই রাত দশটার সময় তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কথা, হোটেল রোহানের পাশে একটা ছোট পার্ক আছে, অত রাত্রে সেখানে জনপ্রাণী থাকবে না, আলোচনা হবে সেখানে।