গুলির শব্দ লক্ষ্য করে সাবধানে এগিয়ে গেল ও। রাওলদের দলটা যা খুঁজছিল তা সহজেই পাওয়া গেল অন্য একটা ঝোঁপের আড়ালে এক ভয়াবহ কান্ড হচ্ছে।
দুটো লোক রক্তাক্ত মাটিতে পড়ে আছে, অন্য দুটো লোক তাদের জামা কাপড় হাতড়াচ্ছে। অনায়াসে বোঝা যায়, এরা সৈন্য দলের অংশ হলেও সময় বিশেষে ডাকাতিতে পিছপাও নয়। স্পেনীয় সৈন্যদের এরকম দুর্নাম চিরদিনই আছে।
রাওলদের দলটাকে দেখতে পেয়েই এই ডাকাত দুটো বুন্দুক তুলে গুলি করল, একজনের গুলিতে রাওলের ঘোড়া আহত হয়ে পড়ে গেল রাওলকে নিয়ে। আততায়ী ছুটে এলো রাওলকে হত্যা করার জন্য।
কিন্তু অন্য আততায়ীর গুলি ব্যর্থ হয়েছে এবং গিচেকে নিজের দিকে এগোতে দেখে সে দ্রুত অদৃশ্য হয়েছে ঝোঁপের আড়ালে, গিচে গিয়ে উদ্ধার করল রাওলকে এবং বন্দি করল তার আততায়ীকে।
এবার আহত লোক দুটিকে পরীক্ষা করে তারা দেখতে পেল যে, একজন মারা গিয়েছে, অন্যজনও সাংঘাতিক আহত, গুলিতে তার উরুর হাড় ভেঙে গুড়ো হয়ে গিয়েছে। রাওলদের প্রাথমিক চিকিৎসায় একটুখানি প্রকৃতিস্থ হয়েই এই আহত লোকটি অতি কাতরভাবে ত দর বলল, ‘ভাই আপনারা আমার প্রাণ বাঁচাবার জন্য বৃথা চেষ্টা করবেন না, বাঁচাবার কোনো সম্ভাবনা আমার নেই, বরং যদি আমার আত্মাকে বাঁচাবার জন্য একটু কষ্ট স্বীকার করেন তাতেই আমার উপকার হবে অনেক বেশি।’
‘আত্মাকে বাঁচানো’? গিচে আর রাওল জিজ্ঞেস করে, ‘কী করতে পারি, বলুন। আপনারাতো খ্রিস্টান! জানেন না কি যে প্রত্যেক খ্রিস্টানেরই উচিত মৃত্যুর পূর্বক্ষণে কোনো ধর্ম যাজকের কাছে সারা জীবনের পাপ স্বীকার করা? অকপটে পাপ স্বীকার করলে ঈশ্বরের পক্ষ থেকে ধর্মযাজক তাকে পাপ থেকে মুক্তি দিতে পারেন, অনুতপ্ত পাপী নরক থেকে রক্ষা পায়।’
‘আপনি কোনো ধর্মযাজকের কাছে পাপ স্বীকার করতে চান?’ জিজ্ঞেস করে দুই তরুণ।
‘একান্তভাবে চাই, না করলে অনন্ত নরকবাস অনিবার্য। আমরা একটা ঘোরতর পাপ করেছিলাম বহুদিন আগে। বিবেকের কাছে তার জন্য দায়ী হয়ে আছি। তা থেকে মুক্তি পাওয়ার আগে যদি মরতে হয় তবে আমার আত্মা মুক্তি পাবে না। আপনারা যান, একজন যাজক এনে দিন আমার কাছে।’
‘কোথায় পাওয়া যাবে যাজক বলতে পারেন?
‘তা পারি। এই পথ ধরেই আধমাইল গেলে একটা সরাইখানা পাবেন। গ্রামটার নাম ঘোনি, ওই গ্রামের শেষ প্রান্তে সন্ন্যাসিদের মঠে আছে একটা। মঠে খবর দিলে সন্নাসীরাই কেউ আসবেন।’
তখন রাওলেরা গাছের ডাল কেটে মাচা বেঁধে চাকরদের দ্বারা আহত লোকটিকে ওই সরাইখানায় নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করল। রাওল আর গিচে ততক্ষণে চলে যাবে ওই মঠে এবং সন্ন্যাসীদের কাউকে সরাইখানায় আসতে অনুরোধ করবে। মঠ থেকে তারা নিজেদের পথে এগিয়ে যাবে, সরাইখানায় আর ফিরবে না, কারণ সময় নেই তাদের। যে কোনো সময় যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যেতে পারে এবং যুদ্ধের আগেই তারা কন্ডির কাছে উপস্থিত হয়ে চায়। রাওল আর গিচে ঘোড়া ছুটিয়ে গ্ৰেনির দিকে চলে গেল। শিক্ষক চাকরের সাহায্যে আহত লোকটিকে নিয়ে আসছেন, তাকে আপাতত সরাইখানায় এনে তোলা হবে, সেখানেই ডাক্তার এবং যাজক ডেকে আনা হবে তার। জন্য।
সরাইখানার সামনে দিয়ে রাস্তা। সেখানে ঢুকে সরাইওয়ালাকে জানানো হলো একজন আহত লোককে তার হোটেলে নিয়ে আসা হচ্ছে। একে আশ্রয় দানের জন্য পাওনা যা হবে, তা সে শিক্ষকের কাছ থেকে পাবে, সে ততক্ষণে একখানা ঘর ঠিক করে রাখুক। তারপরই তারা ছুটল গ্রামের শেষে মঠের অভিমুখে, সেখান থেকে একজন যাজককে এক্ষুণি পাঠানো চাই।
ভাগ্য ভালো মঠ পর্যন্ত যেতে হলো না, নির্জন গ্রামের রাস্তা দিয়ে একটা গাধা আসছে যথাসম্ভব দ্রুতবেগে। তার পিঠে এক আরোহী। পোষাক দেখে তাকে সন্ন্যাসী শ্রেণীর ধর্মযাজক বলেই মনে হবে। দুই বন্ধু উৎফুল্ল, তাদের কাজ সহজ হয়ে এল।
তাড়াতাড়ি গাধার মুখোমুখি দাঁড়াল তারা যাজকের দিকে এক পলক তাকিয়ে। কিন্তু কী রকম যেন লাগল তাদের। লোকটির বয়স কুড়ি বাইশের না, তবু বিভীষিকার একটা আবহাওয়া যেন ঘিরে রেখেছে ওকে। যাজক দেখলে যে সমবোধ মনে আসার কথা তা মোটেই আসছে না এদের মনে।
তা না আসুক, একে এখন প্রয়োজন, সুতরাং কণ্ঠস্বর যথাসম্ভব কোমল একং নম্র করে রাওল বলল–‘গুরুদেব, একটি আহত লোককে শেষ সান্ত্বনা দেয়ার জন্য আপনার কাছে কি আমরা অনুরোধ জানাতে পারি? সে কাছেই আছে।’
আশ্চর্য যাজকটি রাওলের কথা যে শুনতে পেয়েছে তাতে তিল মাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু সে কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যায় কেন?
পাশ কাটিয়ে সত্যিই চলে যাচ্ছে লোকটা।
গিচে এ ঔদ্ধত্য সহ্য করতে পারল না, ঘোড়ার মুখ ঘুড়িয়ে দিয়ে রাস্তা বন্ধ করল গাধার তারপর কঠিন স্বরে বলে উঠল, ‘এ আপনার কি রকম ব্যবহার যাজকভাই? প্রশ্ন শুনলে তার জবাব দিতে হয়, সেটা সাধারণ ভদ্রতা। আপনাকে যে অনুরোধ করা হয়েছে, সেটার সঙ্গে তো আপনার পোষাকের কোনো বিরোধ নেই।’
‘কথার উত্তর দেয়া না দেয়া আমার ইচ্ছে।’ নিচু গলায় অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে জবাব দিল যাজক।
‘ইচ্ছে?’ গর্জে উঠল গিচে। আমরা সে শ্রেণির লোক নই, যাদের কথার উত্তর না দিয়ে চলে যাওয়া যায়।
রাওল দেখল যে কলহ বাধলে মৃত প্রায় লোকটির কাছে যাজককে নিয়ে যেতে ব্যাঘাতই সৃষ্টি হবে, সে শান্তভাবে কথা বলল রাগী যাজককে ঠাণ্ডা করার জন্য, তার প্রয়োজনের কথা বুঝিয়ে বলল এবং আবার অনুরোধ করল–যাজক যাতে অবিলম্বে সরাইখানায় গিয়ে ধর্মীয় সান্তনা দেন মুহুর্মুকে। গিচের কিন্তু রাগ কমে না। সে আবারও ধমকে উঠল, আপনি যদি না যান, আপনাকে বাধ্য করতে আমরা জানি।