পঞ্চাশজন ঘোড়া সওয়ার এসে ঘিরে ফেলেছেন দ্যার্তেগা আর। পোর্থর্সকে ‘আপনারা আমার বন্দি, অস্ত্রসমর্পন করুন’ আদেশ দিলেন বোফক্ট।
‘জীবন থাকতে নয়।’ স্পষ্ট জবাব দ্যার্তেগার।
অ্যাথোস এগিয়ে গিয়ে বোফটকে কানে কানে কিছু বলল,
‘তখন আপনাকে আমার অদেয় কিছু নেই,’ এই বলে ডিউক সঙ্গীদের নিয়ে ভেন্ডোমের পথে অগ্রসর হলেন।
অ্যাথোস আর অ্যারামিসকেও তার সঙ্গী হতে হলো, কিন্তু যাওয়ার আগে অ্যাথোস বুকে জড়িয়ে ধরল দ্যার্তেগা ও পোর্থসকে বলল, ‘কাল নিশ্চয়ই দেখা করব। জীবন থাকতে আমাদের বন্ধুত্বকে ক্ষুণ্ণ হতে দেব না।’
সে আশ্বাসের মূল্য এখন কি মর্মান্তিক দ্যার্তেগার কাছে? জীবনে এতবড় পরাজয় তার ভাগ্যে আর কখনও ঘটেনি।
.
২.
যেমন সীমান্ত যুদ্ধ চলছে কিছুদিন থেকে। রবরয় বিজয়ী প্রিন্স কন্ডি সেখানে ফরাসি সৈন্য পরিচালনা করছে, গ্রামন্ট আর শ্যাট্রিলনের দুই ডিউক সহকারী হিসাবে রয়েছেন তার সঙ্গে। গ্রামান্টের একমাত্র পুত্র, কাউন্ট গিচে, তার বয়স ষোলো কি সতেরো। প্যারিস থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা দিয়েছে। পিতার সঙ্গে থেকে সে যুদ্ধবিদ্যা শিখবে। সঙ্গে আছেন তার পৌঢ় শিক্ষক এবং দুই সশস্ত্র চাকর। এদের সবাই ঘোড়ার পিঠেই ভ্রমণ করছেন।
পথে পড়ল খরস্রোতা অয়সি নদী, পারাপারের জন্য আছে নৌকা, এত চওড়া আর মজবুত নৌকা যে, ঘোড়া সহই তার উপরে উঠে যায় গিচেও সবাই মিলে উঠেছে। নৌকা প্রায় মাঝ নদীতে।
হঠাৎ কেন জানি গিচের ঘোড়াটা ভয় পেয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল গিচকে পিঠে নিয়ে, হায় হায় করতে করতে লাফিয়ে পড়লের গিচের বৃদ্ধ শিক্ষকও কারণ তিনি জানেন গিচ সাঁতার জানে না।
গিচ ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে গিয়েছে, তলিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষক উজান ঠেলে তার কাছে পৌঁছাতে পারছেন না। নৌকায় অন্য যাত্রী যারা আছেন, তারা বোকার মতো তাকিয়ে আছে, নদীতে লাফ দিয়ে পড়ার মতো সাহস তাদের কারোরই হচ্ছে না।
গিচে তলিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষক বেচারী সাঁতার দিতে দিতে করুণ আর্তনাদ করে চলেছেন বাঁচাও, বাঁচাও।
বাঁচাবার কি কেউ নেই?
আছে পনেরো বছরের একটা ছেলে লাফিয়ে পড়েছে জলে, নৌকা থেকে নয়, সে পাড়ে দাঁড়িয়ে ছিল পরবর্তী খেয়ার অপেক্ষায়। সেই নদীর পাড় থেকেই সে ঝাঁপ দিয়েছে।
সাঁতারে অসাধারণ পটু এই কিশোর আর তার সুবিধে এই, স্রোতের পক্ষেই সে আসছে। দেখতে দেখতে সে এসে পড়ল, গিচে জলের তলায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে এমন সময় কিশোর এসে তার চুল ধরে টেনে তুলল, টেনে নিয়ে তাকে ধরিয়ে দিল তারই ঘোড়ার কেশর, তারপর গিচের দিকে লক্ষ্য রেখে ঘোড়াটাকেই চালিয়ে নিতে লাগল পাড়ের দিকে।
তীরে পৌঁছে গিচেকে সুস্থ করে তুলতে বেশি সময় লাগল না, গিচের কৃতজ্ঞতার সীমা নেই, শিক্ষক এই অপরিচিত কিশোরকে নিয়ে মেতে উঠলেন এক বারে। গিচে বলে উঠল, ‘আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু হলে, সারা জীবনের মতো অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। আমি কাউন্ট গিচে, ডিউক গ্রামন্ট আমার বাবা। তার সঙ্গে যোগ দিতে যাচ্ছি যুদ্ধ ক্ষেত্রে।
পরিচয় পেলেই পাল্টা পরিচয় দিতে হয়, কিশোর বলল, আমি রাওল, ভাই কাউন্ট ব্রাগোলেন। কাউন্ট ড্যা-লা-ফেয়ারই প্যারিসের মাস্কেটিয়ারও রাজনৈতিকদের সমাজে অ্যাথোস নামে পরিচিত।
রাওলও যুদ্ধেই চলেছে, প্রিন্স কন্ডির কাছে যাচ্ছে, তারই বোনের সুপারিশ নিয়ে।
প্রথম বয়সের বন্ধুত্ব, দেখতে দেখতে তা গম্ভীর হয়ে উঠে। বিশেষত যেখানে শিক্ষা দীক্ষা মনের মিল থাকে, এখানেও তাই হয়েছে। চব্বিশ ঘণ্টা না পেরুতেই গিচে আর রাওল সমপ্রাণ বন্ধুতে পরিণত হলো। এক সঙ্গে ভ্রমণ করবে, এক হোটেলে থাকবে, এক টেবিলে খাবে, একই রুমে ঘুমাবে।
প্রথম দিন নির্ঞ্ঝাটে কাটল, মনের আনন্দে পথ চলছে দুই বন্ধু। রাওলের মনে শুধু একটাই চিন্তা গ্রিমড এসে পৌঁছেছে কিনা।
গ্রিমড ছিল ডিউক বোফর্টের সঙ্গে। আসলে গ্রিমডের সাহায্যেই বোর্টের ভিনসেন দুর্গ থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিল।
রাওলকে বিদায় দেয়ার সময় অ্যাথোস বলে দিয়েছে–প্যারিস গিয়েই সেখান থেকে তিনি গ্রিমডকে পাঠাবেন রাওলের সঙ্গী হওয়ার জন্য, গ্রিমড সঙ্গে থাকলে রাওলের সম্পর্কে তিনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। ও হবে সহকারী ও অভিভাবক। গ্রিমড যাতে রাওলকে খুঁজে পায়, তার জন্যই প্রতি হোটেলে রাওল হোটেলের মালিককে বলে যাচ্ছে গ্রিমডের নাম–এখানে এলেই তাকে ওখানে যেতে বলবেন দেরি না করেই।
দ্বিতীয় দিনে গিচে রাওলের দলটি বেথুন শহরের কাছে এসে পড়ল, প্রিন্স কন্ডিকে এখানেই পাবার আসা করেছিল তারা, কিন্তু এখানে খবর পেলে কন্ডি বেথুন ত্যাগ করে কাম্পিয়ার পিছু হঠেছেন।
তাহলে ওদের আর বেথুনের দিকে যাওয়ার কোনো কারণ থাকে না।
নদীর ধারে ছোট ছোট ঝোঁপ ঝাড়। এক একটা এমন ঘন যে বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না তার ভেতরের চেহারা। এর একটার পাশ দিয়ে ওরা যখন ঘোড়া ছুটিয়ে চলেছে, হঠাৎ শোনা গেল পরপর কয়েকটা বন্দুকের শব্দ।
সবাই ওরা কানখাড়া করে ফেলল ঘোড়া থামিয়ে। কাছেই শত্রু সৈন্য রয়েছে, তা হলে কন্ডি বেথুনে ত্যাগ করতেন না, সেই শত্রু সৈন্যের কোনো ছোট দল কাছে থাকা অসম্ভব নয়। সঠিক সন্ধান না নিয়ে আর অগ্রসর হওয়া উচিত নয়।