ম্যাজারিন তাড়াতাড়ি বললেন–‘চল যাচ্ছি।’
ঘরের দরজা খুলে সবার আগে ম্যাজারিন বেরুলেন। তার সামান্য পিছনে ডাইনে বায়ে দ্যার্তেগা ও পোর্থস, দুইনেরই হাতে গুলি ভরা পিস্তল। দ্যার্তেগা ম্যাজারিনের কানে কানে বলছে–‘চালাকির বিন্দুমাত্র চেষ্টা করলে দুইদিক থেকে দুটো গুলি আপনার পিছনে ঢুকবে, সুতরাং সাবধানে।
ইঙ্গিত বোঝেন ম্যাজারিন–ধীরে ধীরে পায়চারি করতেই যেন বাগানের দিকে চলেছেন। সঙ্গে দুইজন সশস্ত্র সুইস গার্ড এবং আর একজন বেসামরিক নিরস্ত্র ভদ্রলোক। অনেকেই দেখল, কিন্তু কেউ কোনো কিছু সন্দেহ করতে পারল না।
বাগানে এসে পৌঁছালেন ম্যাজারিন। ওই যে দেয়াল দেখা যায়। লাফিয়ে চলে যান, এদিকে কোনো প্রহরী নেই।
‘কই-এ অন্ধকানে দেয়াল তো চোখে পড়ছে না। আপনি দয়া করে আর একটু কষ্ট করুন প্রভু। দেয়াল পর্যন্তই পৌঁছে দিন আমাদের।’
ম্যাজারিনের পাঁজরায় কি যেন ঠেকছে। তার মানে হলো একটা পিস্তলের নল। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে বাগান পেরিয়ে চললেন
দ্যার্তেগা বলল–‘পোর্থসের কাঁধে উঠে অ্যাথোস দেয়াল পার হও, লাফিয়ে ওপরে নাম।
অ্যাথোস ওপারে লাফিয়ে পড়ল।
তারপর দ্যার্তেগা উঠল পোর্থসের কাঁধে–‘কার্ডিনালের পাঁজর থেকে পিস্তল সরিও না পোর্থস।
দ্যার্তেগা দেয়ালের মাথায় শক্ত হয়ে বসে বলল–এবার কার্ডিনালকে তুলে ধরে আমার কাছে দাও পোর্থস। কার্ডিনাল আমি কিন্তু উপর থেকে পিস্তল ধরে আছি। আপনি টু শব্দটি করলেই গুলি করতে বাধ্য হব।
ম্যাজারিন টু শব্দটিও করলেন না। নিঃশব্দে উঠে গেলেন দেয়ালে, দ্যার্তেগা হাত বাড়িয়ে তুলল তাকে।
এবার দ্যার্তেগা কার্ডিনালকে ধরে,তাকে নামিয়ে দিল দেয়ালের ওপাশে অ্যাথোস রয়েছে ওখানে, সে ম্যাজারিনকে ধরে নামিয়ে নিল।
তারপর নিজের বেল্ট খুলে সেটা ঝুলিয়ে দিল দ্যার্তেগা। ওটা ধরে দেয়াল বেয়ে উঠতে লাগল পোর্থস। দেয়াল কাঁপছে থর থর করে। বুঝি ভেঙে পড়ে। কিন্তু টিকে গেল কোনো রকমে। পোর্থর্স উঠে বসল দেয়ালের উপর। এবং ওপাশে লাফিয়ে পড়ল। তারপর লাফিয়ে পড়ল দ্যাগো।
ওদিকে ছুটে আসছে ওরা কারা? গ্রিমড, গ্রিমডের পর অ্যারামিস, অ্যারামিসের পিছনে রাওল। প্রত্যেকে প্রত্যেককে জড়িয়ে ধরল। এদিকে ঘোড়া তৈরি। তৈরি ষাটজন দেহরক্ষী এবং ফ্রন্ডিওয়ালা। কন্ডি এদের ধার দিয়েছেন অ্যারামিসের সাহায্যের জন্যে।
ম্যাজারিন আশা করছিলেন, ওরা তাকে এবার ছেড়ে দেবে। কিন্তু সে বৃথা আশা। দ্যার্তেগা তাকে ঘোড়ায় চড়তে বাধা দিল। ঘোড়াগুলো পোর্থসের জমিদারি ব্রাসিওজ দুর্গের দিকে ছুটল।
রানীর কাছে, সেন্ট জার্মেইনে পরদিন দ্যার্তেগা ফিরে এল।
রানী অবাক। তিনি জানেন রুইল প্রাসাদে দ্যার্তেগা বন্দি হয়ে আছে।
‘আমি বন্দি নই, রানী-বন্দি এখন কার্ডিনাল ম্যাজারিন।
ম্যাজারিন বন্দি? এটা ঠিক বেরুলুইন গোপন সংবাদ দিয়ে গিয়েছে রানীকে যে কার্ডিনাল নিরুদ্দেশ হয়েছেন।
সে নিরুদ্দেশের অর্থ যে, কার্ডিনাল ব্রামিওজ দুর্গে বন্দি, একথা রানী স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।
তিনি গর্জন করে বললেন–দুঃসাহসী সৈনিক। তুমি কার্ডিনাল ম্যাজারিনের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার স্পর্ধা কর?
দ্যার্তেগা বিনীতভাবে বলে,–‘আমি চিরদিনই দুঃসাহসী, মহারানী। ম্যাজারিনের আগে রিশলুর সঙ্গেও পাঞ্জা লড়েছিলাম এক সময়। মহারানীর অবশ্য তা মনে থাকার কথা নয়।
রানী অ্যান মনে লজ্জা পেলেন একটু,–এই সেই দ্যার্তেগা যার দুঃসাহসের কারণে একসময় তিরি চরম অপমানের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।
কিন্তু মনের লজ্জা মুখে প্রকাশ করার লোক রানী নয়। তিনি ভয় দেখিয়ে বললেন–‘সব সময় দুঃসাহস ভালো হয় না। আমি এখনই সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে দিচ্ছি। তারা ব্রাসিওজ দুর্গ মাটির সাথে মিটিয়ে দিয়ে কার্ডিনালকে উদ্ধার করে আনবে।’
‘ব্রাসিওজ দুর্গ শেষ করা আপনার পক্ষে অবশ্য অতি সহজ কাজ রানী। কিন্তু কার্ডিনালকে জীবিত আনা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমার দূত গিরি যদি সফল না হয়, আমি যদি আজকের মধ্যে নিরাপদে ব্রাসিওজে না ফিরি বা আবার ফিরে যাওয়ার আগে যদি রাজসৈন্য ও পথে যাত্রা করে, তাহলে কার্ডিনাল ম্যাজারিনের জীবনের মূল্য এক ফ্রাঙ্কও নয়। আমরা সব মরিয়া এবং বেপরোয়া। জীবন মৃত্যু আমাদের কাছে খেলার বস্তু মহারানী–এটা স্মরণ রাখলে ভালো করবেন।’
রানী চিন্তা করে দেখলেন, বুঝতে পারলেন দ্যার্তেগার প্রস্তাবে রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই তার। তিনি প্রশ্ন করলেন, কি তোমাদের দাবি?
দাবির একটা লিস্ট করেই এনেছে দ্যার্তেগা। ফণ্ডিওয়ালের সব দাবির পরও দ্যার্তেগাদের ব্যক্তিগত দাবিগুলোও এতে আছে। প্রথম দ্যার্তেগাকে ক্যাপ্টেনের পদ ও লক্ষ ফ্রাঙ্ক পুরষ্কার দিতে হবে। পোর্থসের জন্য মঞ্জুর করতে হবে ব্যারণ উপাধি। অ্যারামিস চায় তার বন্ধু লাংভিলের ডিউকের জন্য নামত্তির শাসন কতৃত্ত্ব এবং পাঁচ লক্ষ ডলার এবং অ্যাথোস–অ্যাথোস কিছুই চায়নি। দিলেও সে নেবে না।
রানী অবাক হয়ে বলেন, ‘যে কিছুই চায় না, এমন লোকও আছে?’
দ্যার্তেগা উত্তর দেয়-’ওই একজনই আছে–অ্যাথোস।’
রানী সন্ধিপত্রে সই করে তারপর বললেন—’রাজা যেদিন প্যারিসে পুনঃপ্রবেশ করছেন সেদিন তার দেহরক্ষা করবে কে?’