দ্যার্তেগা সংক্ষেপে উত্তর দিল–‘জা জা’–অর্থাৎ হা হা। ম্যাজারিন চলেছেন, রাস্তার মাথায় লতার ঝোঁপ–তার ভেতর কমলালেবুর বড় বড় টব। ম্যাজারিন সতর্কভাবে চারিদিকে তাকিয়ে একটি বিশেষ টবের পাশে লণ্ঠনটি রাখলেন। প্রহরীদেরও চোখে পড়ল না। এখন নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি বিশেষ একটা টবের গায়ে একটা কল ঘুরিয়ে দিলেন। সাথে সাথে গাছসহ টবটা ঘুরতে ঘুরতে অনেকখানি সরে গেল। আর ম্যাজারিন মাটির নিচে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। টব আবার আগের জায়গায় ফিরে এল।
প্রহরীদের ম্যাজারিন দেখতে পাননি। কিন্তু তারা কাছেই ছিল। ওই টবের আড়ালে তারা লুকিয়েছিল। ঘুরন্ত টবের নিচে সিঁড়ি এবং সিঁড়ি বেয়ে ম্যাজারিনের মাটির নিচে যাওয়া কিছুরই নজরে এড়ায়নি তাদের।
এখন এগিয়ে গেল তারা। আবার কল ঘুরিয়ে টব সরাল–তারপর সেই সিঁড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে নেমে একটা ছোট ঘরে এসে দাঁড়াল। ম্যাজারিন সেখানেই রয়েছে, কিন্তু এদের দিকে পিছন ফিরে দেখতে পেলো না অবাঞ্চিত অতিথিদের। আর অন্য দিকে চোখ ফেরায় কীভাবে? সামনে এক অপূর্ব দৃশ্য। সারি সারি সিন্দুক সাজানো দেয়ালের পাশে। সবগুলোরই ঢাকনি খোলা, ওগুলো থেকে ঠিকরে বেরুচ্ছে উজ্জ্বল আলো। লণ্ঠনটা বাইরেই আছে। কিন্তু এখানে ঢুকে ম্যাজারিন জ্বেলে দিয়েছে কয়েকটি মোমবাতি। তার আলোতে প্রতিটি সিন্দুকের হীরে জহরতগুলো এমনি আলো ছড়াচ্ছে।
দ্যার্তেগা কানে কানে বলল পোর্থসকে ম্যাজারিন এখন কোষাগার তৈরি করেছেন রিশলুর কবরখানায়। সমস্ত ফরাসি দেশ লুট করে এনে দরিদ্রের মুখের খাবার জমা করা হচ্ছে এই ঘরে।
বলে উঠল পোর্থস–‘ওকে এখানেই গলা টিপে শেষ করে দেই।’
‘পাগল! তা যদি করি, অ্যাথোসকে মুক্ত করব কেমন করে?’
আর দেরি না করে দ্যার্তেগা আর পোর্থস পা টিপে উঠে এল সিঁড়ি বেয়ে। এসে টব আবার আগের জায়গায় রেখে টহল দিতে লাগল বন্দিশালার সামনে। সেখানে ঘরের ভেতর মুখবাঁধা সুইস গার্ড দুইজন নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে।
ম্যাজারিন একটু পরেই উঠে এলেন। রোজ সন্ধ্যায় একবার ধনরত্নগুলো না দেখলে রাতে তার ঘুম হয় না।
প্রহরীদের কাছে এসে ম্যাজারিন তাদের ডাক দিলেন–এসো আমার সঙ্গে। দ্যার্তেগা উত্তর দিল–জা জা।
সামনে ম্যাজারিন, পিছনে দুই সুইস গার্ড। অনেকেই লক্ষ্য করল এদের যেতে, কেউ কোনো কথা বলার দরকার মনে করল না, ম্যাজারিন এর সাথে অযথা কি কথা বলবে।
অনেক আঁকাবাঁকা বারান্দা পার হয়ে, চাবি দিয়ে একটি ঘরের তালা খুলে ফেললেন ম্যাজারিন। তিনি ঢুকলেন, পিছন পিছন সুইস দুইজনও ঢুকল।
ম্যাজারিন বললেন–‘নমস্কার কাউন্ট। আপনার সঙ্গে নির্জনে আলাপের সুযোগ পেয়ে আমি অনেক খুশী। আমি ইংল্যান্ডের ঘটনা সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করব। আপনি মন খুলে সত্য উত্তর দেবেন–এই আমার অনুরোধ।
অ্যাথোস কোনো উত্তর দেয়ার আগেই পরিষ্কার বিশুদ্ধ ফরাসি ভাষায় দ্যার্তেগা বলে উঠল–হ্যাঁ, আপনি স্বচ্ছন্দে মন খুলে কথা বলতে পরেন কাউন্ট। কারণ এই সুইস গার্ড দুটো ফরাসি ভাষা একদম বোঝে না।’ ঘরের মধ্যে যদি বাজও পড়ত তাতেও মনে হয় ম্যাজারিন এত বেশি চমকাতেন না। ঘরের দরজার ভেতর থেকে বন্ধ করে তাতে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়েছে পোস।
অ্যাথোস এসে দ্যার্তেগার হাত ধরল–‘তুমি?
ম্যাজারিন বিচলিত ভাবটা গোপন রাখার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘মঁসিয়ে। আপনারা দান উলটে দিয়েছেন বলে ভাবতে পারেন। কিন্তু সে আপনাদের ভুল। আমার হাতের এই বাঁশিতে ফুঁ দিলেই কমিঞ্জে এসে পড়বে তার বিশজন সৈন্য নিয়ে।
দ্যার্তেগা বলল–ভুল আমাদের নয়। ভুল আপনার কার্ডিনাল, বাঁশিতে ফুঁ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার তরবারি আপনার বুকে প্রবেশ করবে সেটা কি আপনি বুঝতে পারছেন না? আমরা মরিয়া লোক, বেপরোয়া, জীবন-মরণ আমাদের কাছে খেলার বস্তু, তা কি আপনি আজও বুঝতে পারেননি? ম্যাজারিন যেন বোবা, অনেক কষ্টে নিজেকে ঠিক করে শেষ পর্যন্ত বললেন ‘আপনারা কি চান, তাই বলুন না হয়।
‘চাই? আবার কি চাইব? মুক্তি চাই। অকারণে অন্যায়ভাবে আমাদের তিনজনকে বন্দি করেছেন আপনি, আমাদের প্রথম দাবি হলো মুক্তি। সেটা না পেলে পরে অন্য সব কথা হবে।’
‘মুক্তি?–বেশ যান, আপনারা মুক্ত, দরজা খুলে যেখানে খুশী চলে যান কেউ আপনাদের বাধা দেবে না।’
‘অনেক ধন্যবাদ কার্ডিনাল। এতই যদি দয়া করলেন। আর একটু দয়া করে আপনার বাগানের পিছন দিক দিয়ে বের হবার রাস্তাটা আমাদের দেখিয়ে দিন।
চোখে সন্দেহ নিয়ে বলে উঠল ম্যাজারিন, কে বলল যে বাগানের পিছন দিক দিয়ে বের হবার একটা রাস্তা আছে?
‘কে আর বলবে? আমরা নিজের চোখে দেখেছি, দেখেছি যে কমলালেবুর টবটা ঘুরিয়ে দিলেই তার নিচে বেরিয়ে পড়ে পাকা সিঁড়ি এবং সেই সিঁড়ি দিয়ে নামলেই চোখে পড়ে বিশাল ধনভাণ্ডার। আপনি কি দয়া করে আমাদের পথ দেখিয়ে দেবেন। যদি না দেন, তবে অবশ্য আপনাকে রেখে আমরা যাব। জীবিত নয় মৃত। জীবিত শত্ৰু পিছনে রেখে যাওয়ার মতো বোকা আমরা নই। তা আপনার বোঝা উচিত।’
জীবনের ভয়ে মোটেই ভীত নয় ম্যাজারিন। যতটা ভয় তার ধনসম্পত্তির কথাটা প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয়ে। সুতরাং এদেরকে বর্তমানে তোয়াজ করতে তিনি বাধ্য।