‘না, কোনো কথা জিজ্ঞাসা করার সময় পাইনি, তারা চলে গেলে দেখি গোটা তিনেক লাশ পড়ে আছে। ঘোড়াসওয়ার সৈন্যের লাশ, আর ছয়জন আহত হয়ে পড়ে আছে। তাদের সরিয়ে ফেলতে গিয়ে এই তরোয়ালের টুকরো পেলাম।’
‘কোথায় নিয়ে গেল কিছু জানেন?’
‘ভরে শহরের দিকে–তাছাড়া আর কিছু জানি না।’
ছোট শহর ভরে। সেখানে একটি মাত্র হোটেল। এই হোটেলের মদ বিখ্যাত। ঘোড়াসওয়ারীরা কি এই বিখ্যাত মদ এক গ্লাস না খেয়েই চলে যাবে এখান থেকে? এত বড় লড়াইয়ের পর। এখানে যদি তারা থেমে থাকে নিশ্চয়ই কোনো চিহ্ন রেখে গিয়েছে দ্যার্তেগা।
হোটেলে ঢুকে দুই গ্লাস মদের অর্ডার দিল অ্যাথোস আর অ্যারামিস এবং দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে লাগল। ঢাকনা হিসাবে একটা চওড়া রূপা এবং দস্তার তৈরি পাত রয়েছে কাউন্টারের উপর। তার উপরে কতগুলো আলপিনের আঁচড়। অক্ষর আকারে আঁচড়গুলো—’এলোমেলো নয়। স্পষ্ট লেখা আছে, রুইন-ডি’।
‘তাহলে ওরা রুইনে গিয়েছে?’
‘সেন্ট জার্মেইনের পাশ হল রুইন। রানী অ্যান আছেন সেন্ট জার্মেইনে, ম্যাজারিন আছে রুইনে।’
‘কার্ডিনাল রিম রুইনে একটা বাড়ি বানিয়েছিলেন। সে বাড়ির নিচে একটা কবরস্থান আছে বলে শোনা যায়। কিছু কবরে মৃতদেহ আছে। কিছু এখনও খালি।’
‘ম্যাজারিন এবার হয়তো খালিগুলি ভর্তি করার মতলবে আছে। দ্যার্তেগার মতো দুর্ধর্ষ লোককে হাতে পেয়ে সে আর ছাড়বে না। সাপের লেজে পা দিয়ে কোনো বুদ্ধিমান লোক তাকে ছেড়ে দেয় না।’
ঘোড়া ছুটছে আর দুই বন্ধু এরকম বলছে, সেন্ট জার্মেইনে আসতে আসতে মন ঠিক করে ফেলেছে তারা। সোজা রানীর কাছে যাবে অ্যাথোস, স্মরণ করিয়ে দেবে পুরান দিনের কথা এবং রানীর কাছে দ্যার্তেগার মুক্তি চাইবে। দ্যার্তেগার এবং পোর্থসের। এমনও হতে পারে রানী হয়তো জানেনই না ম্যাজারিনের-এ কাজের কথা।
সন্দেহ নিয়ে মাথা নাড়ে অ্যারামিস। অ্যাথোসের মতো সরল নয় সে। রানীর সঙ্গে দেখা করে অ্যাথোস কোনো কাজই আদায় করতে পারবে না বলে অ্যারামিসের বিশ্বাস, উল্টো সে নিজেই বন্দি হয়ে পড়বে।
সুতরাং সাবধানী অ্যারামিস বলল—’তুমি রানীর কাছে যেত চাও যাও। আমি যাই মহা যাজক ফ্ৰণ্ডির কাছে। ফ্ৰণ্ডির দলের কিছু লোক চেয়ে নেই তার কাছে। কাজে লাগবে হয়ত।’
‘বোকার মতো কোনো কাজ করো না’–বলে বিদায় নিল অ্যায়োস।
রানীর দরবার। নানা লোক এসেছে দেখা করতে। কাউন্ট দ্য-লা ফেয়ারের নাম সাক্ষাৎ প্রার্থীর তালিকায় দেখেই রানীর ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো। দ্যা-লা-ফেয়ারের মানে সেই অ্যাথোস তো? বাকিংহামের ব্যাপারে যে চার সৈনিক রানীর মর্যাদা রক্ষা করেছিল, তাদেরই একজন। প্রত্যেকের জীবনে অনেক সময় আসে যখন আগের দিনের উপকারীর নাম শুনলে রাগ। হয়ে যায়।
কিন্তু কাউন্ট দ্যা-লা-ফেয়ার ফরাসি দেশের অভিজাত শ্রেণীর অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তি। তিনি দেখা করতে এলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া অসম্ভব। সেটা সমস্ত প্রিন্স এবং ডিউকদের আঘাত করার মতো হবে। বর্তমান সংকটের সময় সে কাজ করার সাহস রানীর নেই।
সুতরাং রানীকে অ্যাথোসের কথা শুনতে হলো। মন না চাইলেও, কথা ধৈৰ্য্য ধরে শুনতে হলো।
অ্যাথোস বলছে,–‘মহারানীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়, লেফটেন্যান্ট দ্যার্তেগা আর তার বন্ধু পোর্থস ওরফে মঁসিয়ে দ্য ভ্যালের নাম। এটাও রানী বিশ্বাস করতে পারেন যে, এই বিশ বছরে রানীর প্রতি তাদের ভক্তি এক তিলও কমে যায়নি।’ রানীর চোখে মুখে মৃদু ব্যাঙের হাসি ফুটে উঠল।–’যাক, ওদের ভক্তি অটুট আছে জেনে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আজকাল তো বিশ্বস্ত প্রজা পাওয়াই শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘দোষটা অবশ্য প্রজাদের, তাতে সন্দেহ নেই,’–সবিনয়ে উত্তর দেয় অ্যাথোস। ‘তবে রাজশক্তির কাছে সুবিচার যখন দুষ্প্রাপ্য হয়, তখন ভক্তি স্বভাবতই কমে আসে বইকি।’
তীক্ষ্ণস্বরে রানী মন্তব্য করেন, ‘সুবিচার দুষ্প্রাপ্য?’
‘বর্তমান ক্ষেত্রেই দেখুন।’ দৃঢ়কণ্ঠে নিবেদন করে অ্যাথোস।
‘মহামন্ত্রী ম্যাজারিনের আদেশে লন্ডনে যেতে হয়েছিল দ্যার্তেগা আর ভ্যালোকে। সেখানে যথা সম্ভব সাহায্য তারা ক্রমওয়েলকে করেছেন। আর তার প্রতিদানে ফ্রান্সে ফিরে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই তার বন্দি হয়েছেন রাজসৈন্যের হাতে।‘
রানীর যেন বিশ্বাস হয় না কথাটা—’আপনি কি এমন কোনো প্রমাণ পেয়েছেন যাতে নিঃসন্দেহে বলতে পারেন যে—’
‘মহারানী আমি তা নিঃসন্দেহে বলতে পারি এবং এও বলতে পারি যে এই মুহূর্তে তারা মহামন্ত্রীর রুইন প্রাসাদে, সম্ভবত সে প্রাসাদের মাটির নিচে কবরখানায় আটক আছে দ্যার্তেগা এবং ভ্যালো।’
রানী এক মুহূর্ত নীরব রইলেন–তারপর বললেন–‘আপনি পাশের ঘরে অপেক্ষা করুন। আমি মঁসিয়ে ম্যাজারিনকে ব্যাপারটা জিজ্ঞাসা করে তারপর আপনাকে জানাচ্ছি যে, আপনার ধারণা কতদূর সত্যি এবং সত্যি হলে এ ব্যাপারে আমরা কি করতে পারি।’ অ্যাথোসকে বাধ্য হয়েই পাশের ঘরে যেতে হলো। বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। গার্ড সেনার লেফটেন্যান্ট কাসি বললেন–‘কাউন্ট আপনার তরবারি খানা আমায় দিন। রানী আপনাকে বন্দি করার আদেশ দিয়েছেন।’
অ্যাথোস জানালা খুলে ফেলল। নিচের চত্বরে ভিরের মধ্যে অ্যারামিস দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাথোস ডেকে বলল—’অ্যারামিস আমি বন্দি হয়েছি।’