শ্যাটল অ্যাথোসকে চুপি চুপি উত্তর দেয়—’মিথ্যা চিরদিনই ঘৃণার। তার প্রচারক যেই হোন না কেন। দুঃখিনী চার্লসের রানী। আমার দুর্ভাগ্য যে এই দুঃসংবাদ আমায় দিতে হল। আপনার মহলে স্বামীর শেষ আদেশ আপনাকে না জানিয়ে আমার উপায় নেই বলেই আমি এখানে এসেছি। মহারানী, মিথ্যাবাদীর ছলনায় ভুল আশা করবে না। আপনার স্বামী আর পৃথিবীতে নেই। তার স্বাক্ষী এই রুমাল।’ রাজার রক্তে ভেজা রুমালটি অ্যাথোস নিজের বুকের ভেতর থেকে বের করে রানীর সামনে রাখাল। অভাগিনী রানী। তিনি তখন অজ্ঞান।
সেদিন সন্ধ্যায় রানী অ্যানের দূত সেনাপতি শ্যাটিলনকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে শেষ করল অ্যারামিস। দুর্ভাগিনী হেনরিয়েটার দুর্ভাগ্য নিয়ে পরিহাস করার জন্য এই সাজা।
কিছুদিন প্যারিসে ঘোরাফেরা করেই অ্যাথোস আর অ্যারামিস বুঝতে পারল যে ফন্ডির বিদ্রোহে জয়ী হওয়ার কোনো আশা নেই। কারণ বিদ্রোহের নায়কেরা সবাই গোপনে গোপনে ম্যাজারিনের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিয়েছে। কেউ পাবে জমিদারী, কেউ উচ্চপদ, কেউ অনেক নগদ টাকা। গরীব জনগণের দুঃদুর্দশার দিকে তাকিয়ে স্বার্থহানি করবে এমন মহান ব্যক্তি একজনও নেই বিদ্রোহী দলপতিদের ভেতর।
তারপর আছে দুঃশ্চিন্তা, এখনও এসে পৌঁছায়নি দ্যার্তেগারা। বারবার দ্যার্তেগার বাসায় গিয়েছে অ্যাথোস। দ্যার্তেগা আসেনি, আর কোনো খবরও পাওয়া যায়নি। দ্যার্তেগা আর পোর্থস–দুইজনেই নিরুদ্দেশ। বন্ধুদের ভাগ্যে কি ঘটেছে, তা না জেনে নিশ্চিন্ত থাকা অ্যাথোস বা অ্যারামিসের পক্ষে সম্ভব নয়। বোর্নোতে ফিরে এসে সেখান থেকে পিকার্ডির পথে যাওয়ার কথা দ্যার্তেগাদের। ওরাও পিকার্ডির পথ ধরল। অনুসন্ধান শুরু করল। প্রতি শহরে যেখানে খাবারের বা রাতে থাকার জন্য দ্যার্তেগাদের অপেক্ষা করার সম্ভাবনা ছিল, সাবধানে জিজ্ঞাসা করে ওরা। না, কোথাও কোনো খবর পাওয়া গেল না।
অবশেষে মনট্রিল শহরের এক হোটেলে খেতে বসেছে অ্যাথোস আর অ্যারামিস। অন্যমনস্কভাবে টেবিলের পর্দার উপর হাত রেখেছে, অ্যাথোসের মনে হলো-চাদরের নিচে কাঠ ঠিক মসৃণ লাগছে না। কৌতূহলের বসে চাদর তুলে একটা নিশানা সে দেখতে পেল।
দেখল, টেবিলের কাঠের ছুরির ফলা দিয়ে লেখা আছে-পোর্থস-দাত রোফেব্রু চমৎকার এখানে তাহলে তারা এসেছিল। রাতটা এখানে কাটাব ভেবেছিলাম। তা আর হবে না, চল এখনই রওনা হই।
অ্যারামিস বলে–‘এখানে এত খোঁজাখুজি করার কোনো দরকার নেই। দ্যার্তেগা হোটেলে বসে আরাম করার পাত্র নয়। কোনো হোটেলে যা হোক কিছু খেয়ে নিয়ে সে রওনা হয়ে গিয়েছে সামনের দিকে। সুতরাং সামনে চল।
আবার তারা পথে নামল। শহরের দরজায় দরজায় একটু খবরের জন্য চেষ্টা, সে যে কী বিরক্তিকর ব্যাপার। কিন্তু বন্ধুত্বের বন্ধন আছে। আছে কৃতজ্ঞতা, আছে আত্ম মর্যাদার প্রশ্ন-কষ্ট বা বিরক্তি কাছে পরাজয় স্বীকার করার পাত্র নয় ওরা।
এবার ওরা কম্পিয়ে শহরের দিকে ছুটল। শহরের গেটের পাশেই একটা সাদা দেয়াল একটা। তার উপর কয়লা দিয়ে কালো ছবি আঁকা। অতি আনাড়ী হাতের আঁকা, তবু স্পষ্ট বোঝা যায়–দুজন ঘোড়ার পিঠে মানুষের ছবি। নিচে লেখা–‘ওরা পিছু নিয়েছে।’
উৎসাহে অ্যাথোস বলে উঠে, আর সন্দেহ নেই, এ দ্যার্তেগা আর পোর্থস, পিছু নিয়েছে, কে?-তা যেই হোক খুব কাছাকাছি পৌঁছুতে পারেনি। শত্রু কাছে থাকলে, দ্যার্তেগা পাঁচ মিনিট ধরে ছবি আঁকতে পারত না।
অ্যারামিস বলে—’কাছে যদি পৌঁছতে না পেরে থাকে, তাহলে হয়তো দ্যার্তেগাদের ধরতেও পারেনি। একটু একটু আশা হচ্ছে।’
‘আমার আশা হচ্ছে না। বন্দি না হলে তারা এরকম অদৃশ্য হবে কেন?’
কী চিন্তা! কি ভাবনা! বিপদের নিশ্চিন্ত খবর পেলেও এতখানি অস্বস্তি ভোগ করতে হত না। অ্যাথোসের হে প্রবণ মন বন্ধুদের অমঙ্গলের আশঙ্কায় অধীর। আবেগ সর্বস্ব অ্যারামিস রশিটানা ঘোড়ার মতো ছটফটিয়ে উঠছে একটু পরপর। তারা ঝড়ের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে চলল ঘণ্টা দুই তিন। হঠাৎ রাস্তার এককোণে দেখতে পেল, কে যেন বড় একখণ্ড পাথর এনে রেখে দিয়েছে। যাতায়াত বন্ধ করার উদ্দেশ্যে নিশ্চয়ই।
মাস্কেটনকে সঙ্গে আনা হয়নি–সে প্যারিসে রয়েছে যদি দ্যার্তেগা বা পোর্থর্স এসে পড়ে সেজন্য। সঙ্গে আছে গ্রিমড আর সেই পিয়ন। তাদের সাহায্যে পাথরখানা উলটে ফেলতেই তারা দেখতে পেল তার তলার দিকে লেখা রয়েছে পীকক হোটেলে আমরা উঠব। হোটেলওয়ালা আমাদের বন্ধু।
‘তবু একটা সঠিক খবর পেলাম, চল পিককে যাই।’
কিন্তু ঘোড়াদের না খাইয়ে আর একপাও চালানো যায় না। ঐখানে। তাদের তিন ঘণ্টা বিশ্রাম নিতে হল।
তারপর পিককে পৌঁছাতে আরও ছয়ঘণ্টা লাগল। হোটেলওয়ালাকে প্রশ্ন করতেই সে এক টুকরো ভাঙা তরোয়াল নিয়ে এল–এটা চিনতে পারছেন? এক নজর দেখেই অ্যাথোস বলল–দ্যার্তেগার তরোয়াল।
‘দু’জনের ভেতর যিনি বিশেষ লম্বা চওড়া তার এটা? না-যিনি ছোটখাট তার?’
‘ছোটখাট জনের।’
তাহলে বুঝতে পারছি, আপনারা সত্যিই ওদের বন্ধু—’শুনুন, এখানে এসে ওরাও ঢুকল। পিছনে ঢুকল আটজন সৈন্য। কিন্তু আটজনেও কিছু করতে পারত না। এই শহরে একদল রাজসৈন্য আছে, সংখ্যায় বিশজন, পেরে উঠলেন না।’
‘কিন্তু তাদের কি অপরাধে ধরা হয়েছে? কিছু শুনেছেন?’