বেশ কিছুদূর দিয়ে একটা বালিয়ারির আড়ালে সবাই বসল, খাওয়া দাওয়া সেরে নিল চটপট, তারপর দ্যার্তেগা বলল-বন্ধুগণ শোন, এবার আমাদের আলাদা আলাদা পথে যেতে হবে। আমি আর পোর্থ একদিকে, অ্যাথোস আর অ্যারামিস অন্যদিকে।
সবাই বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন? আলাদা পথে কেন?’
‘ভুলে গেলে? তোমরা কন্ডির দলে। এই দুই দলের ভেতর মেলা মেলা দেখলে দুই দলের নেতারাই সন্দেহ করবে।’
দ্যার্তেগাকে বিদায় দিতে ইচ্ছা নেই অ্যাথোসের, ইংল্যান্ডে বিভিন্ন বিপদের ভেতর দিয়ে বুদ্ধিমান সেনাপতির মতো সে অদ্ভুত কৌশলে সবাইকে চালিয়ে নিয়ে এসেছে। তার স্মৃতি দ্যার্তেগার প্রতি আগের চাইতেও বেশি আকর্ষণ করেছে। সে শুধুই বলে–‘সবাই একসাথে থাকাই নিরাপদ। আর এ এলাকায় রানীর দলের শক্তি বেশি। রানী মানেই ম্যাজারিন। সুতরাং ম্যাজারিনের দলের দ্যার্তেগা অনায়াসে আমাদের রক্ষা করতে পারবে। আমরা একপাও সামনে যেতে পারব না ও সঙ্গে না থাকলে। রাজ সৈন্যের হাতে বন্দি হয়ে যাব।’
‘তোমরা ভেন্ডোমার ভেতর দিয়ে প্যারিসের দিকে চলে যাও। ওটা বোফোর্টের জমিদারী। তোমাদের ফ্রন্ডিদেরই অধিকার ওখানে। আমরা। নিবার্ডির পথে যাচ্ছি। প্যারিসে দেখা হবে।’
সবাইকে পরাজয় মেনে নিতে হলো দ্যার্তেগার জিদের কাছে। অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে অ্যাথোস আর অ্যারামিস বিদায় নিল দ্যার্তেগা আর পোর্থসের কাছে। গ্রিমড, ব্রেইয়িইস আর মাস্কেটন সবাইকে অ্যাথোসের সঙ্গে পাঠিয়ে দিল দ্যার্তেগা। চাকর একটাও সঙ্গে থাকবে না। পোর্থস একবার বিদ্রোহ করতে যাচ্ছিল। কিন্তু কনুই দিয়ে দ্যার্তেগা তাকে এমন গুতো দিল যে, সে। আর আপত্তি করতে সাহস পেল না।
বিদায় নেয়ার পর দুইদল দুই দিকে রওনা হলো। সবারই মন খারাপ। ইংল্যান্ডে চরম বিপদের দিনেও মন তাদের এমন মুষড়ে পড়েনি কোনো দিন, কারণ তখন এক সঙ্গে চার বন্ধু ছিল। আজ কেন এ ছাড়াছাড়ি, কে তা বলে দেবে? এ ছাড়াছাড়ি কি চিরদিনের?
কিছুদূর গিয়ে পোর্থস হঠাৎ রাগী গলায় বলে উঠল–তুমি কিন্তু এটা অন্যায় করছ দ্যার্তেগা। অ্যাথোসকে বিপদের মুখে ছেড়ে দিয়ে আমরা দুইজনে তোফা নিরাপদে পথ চলেছি। এরকম স্বার্থপরতা তোমার ভেতর দেখতে পাব এ আমি কোনোদিন ভাবিনি।
দ্যার্তেগা এক মুহূর্ত নীরবে তার দিকে তাকিয়ে রইল, তার ঠোঁটের কোণে করুণ হাসি ফুটে উঠল। তারপর সে ধীরে ধীরে বলল—’সরল, মহৎ পোর্থস। অ্যাথেসেরা বিপদে নয়। বিপদে আছি আমরাই। আমাদের সঙ্গে থাকলেই ওদের বিপদের সম্ভাবনা ছিল। ভেণ্ডোমের পথে ফ্ৰণ্ডিরা নিরাপদ। আমি বা তুমি কোথাও নিরাপদ নই।’
‘কেন? কেন? আমরাও ম্যাজারিনের দলে। এ অঞ্চল ম্যাজারিনের অধীনে।’
‘আমরা ম্যাজারিনের দলেই ছিলাম। কিন্তু দলদ্রোহী হয়ে পড়েছি। ম্যাজারিন আমাদের ইংল্যান্ডে পাঠিয়েছিল ক্রমওয়েলকে সাহায্য করার জন্য। মর্ডন্টের অধীন হয়ে থাকার জন্য। তা না করে আমরা রাজা চার্লসকে উদ্ধার করার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করেছি। ভাগ্য খারাপ না হলে উদ্ধার করতেও পারতাম। আর মর্ডন্ট, তাকেও আমরা হত্যাই করেছি। ম্যাজারিন এর মধ্যেই সব খবর পেয়ে গেছে। এ আমি শপথ করে তোমায় বলতে পারি। কাজেই যারা তার হুকুমের বিরুদ্ধে উল্টো কাজ করেছে, যারা তাকে ক্রমওয়েলের বিরাগভাজন করেছে তাদের উপর ম্যাজারিনের দলের প্রতিক্রিয়া কি রূপ হবে, অনুমান করতে পারছ?’
‘ও ব্যাটার মনের ভাব সম্বন্ধে আমি কিছু জানি না বন্ধু, তবে ওর আগের কার্ডিনাল যে রিশশু, তার মনের ভাব এরকম অবস্থায় কী রকম দাঁড়াত, তা বলতে পারি। রিশলু আমাদের খতম করার জন্য প্রতি রাস্তার মোড়ে গুণ্ডা রাখত।’
‘এ তার চেয়ে কম কিছু করবে না ঠিক জেনো।’
‘আমার ব্যারণ উপাধিটা তা হলে আকাশ কুসুমই থেকে গেল, আহা’ একটা নিঃশ্বাস ফেলে পোর্থ বলল।
‘মোটেই না।’ দ্যার্তেগা মনে মনে যতই দমে যাক, বন্ধুকে দমতে দেবে না, ‘বলল, তুমি আমার উপর বিশ্বাস রাখো। ওই ম্যাজারিনের কাছ থেকে তোমার ব্যারণ উপাধি আমি আদায় করে দেবই।’
ভেন্ডমের ভেতর দিয়ে নিরাপদে প্যারিসে পৌঁছাল অ্যাথোস আর অ্যারামিস। সেখানে গিয়ে প্রধান কর্তব্য রানী হেনরিয়েটাকে দুঃসংবাদ দেয়া। কিন্তু কর্তব্য কর্তব্যই। অ্যাথোস প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আছে রাজার শেষ সংবাদ রানীকে দেবার জন্য। শোকবার্তা বলে সে কর্তব্য এড়িয়ে যাওয়া চলে না।
ধূর্ত ম্যাজারিন–পাষণ্ড ম্যাজারিন।
লুভর প্রাসাদে গিয়ে অ্যাথোস আর অ্যারামিস দেখে, রানী হেনরিয়েটা খুশি মেনে প্রায় হাসি হাসি মুখে আলাপ করছেন দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে। এরা ফ্রান্সের অভিজাত শ্রেণীর গণ্যমান্য লোক। অ্যাথোস অ্যারামিস দুজনেরই পরিচিত। এদের একজন শ্যাটিলনের ডিউক, বিখ্যাত সেনাপতি।
অ্যাথোসদের দেখে রানী খুশি হয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানালেন ‘আসুন, আমার স্বামীর কুশল সংবাদ দিতে আপনারাও এসেছে দেখছি। কিন্তু দেখেছেন তো রানী অ্যান দেরি না করে নিজের দূত পাঠিয়েছেন আমাকে আনন্দ সংবাদ দিতে।’
আনন্দ সংবাদই? কি আনন্দ সংবাদ? আর্তনাদের মতো শোনায় অ্যাথোসের স্বর। রানী হেনরিয়েটা চমকে উঠেন তার কণ্ঠস্বরে। কে যেন প্রচণ্ড হাতুড়ির আঘাত হানে তার বুকের ভেতর। তিনি প্রায় ককিয়ে উঠেন—’কেন? রানী অ্যানের দূতেরা বলছেন আমার স্বামীকে তারা বধ্যমঞ্চে নিয়ে এসেছিল, সেই সময় তাকে উদ্ধার করেছে তার অনুরক্ত প্রজারা। তিনি আবার একটা সৈন্যদল পরিচালনা করছেন। সিংহাসন উদ্ধারের আশা খুবই বেশি। তার ওই মুহূর্তে আপনারাতো ইংল্যান্ডেই ছিলেন তার কাছে। আপনাদের এসব স্বচক্ষে দেখার কথা এসব। এরা যা বলছে তার কি সত্য নয়?’